গল্প পড়ার গল্প
বিরল শিল্পী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর জন্মের শতবর্ষ পার হয়ে গেলেন নিঃশব্দে। তিনি ১৯১২ সালের ২০ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লায়। গত ২০১২ সালেই জন্মশত বর্ষ পার হয়ে গেল তাঁর। আমি যেন দেখতে পাই কলেজ স্ট্রিট থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে শতবর্ষ পার করা লেখক একা একা হেঁটে চলেছেন শিয়ালদহের দিকে। বেলেঘাটা পার করে পূব কলকাতার কোথায় যেন তিনি থাকেন। মাঝেমধ্যে বাড়ি বদলান। খোলার ঘর, নিম বুনো আম, জারুল, নানা লতা গুল্মে ভরা একটি আশ্রয় তাঁর। সেখানে নানা পাখি, ফড়িং কাঠবিড়ালি আর সবুজ পাতারা এক বৃদ্ধের সঙ্গে দ্যাখে মায়ার স্নান বিলাস।
আমি সেই গিরগিটি গল্পের কথা বলছি। বৃদ্ধের ছিল সৌন্দর্যপ্রিয়তা। সে দেখত রূপ। আর তার চোখের ভিতর দিয়ে মায়া দেখত নিজেকে। বৃদ্ধ যে তাকে দ্যাখে তা কি মায়া জানত না? গাছের পাতা, শালিখ, ফড়িংও তাকে দ্যাখে সেই কুয়োতলায় স্নানের সময়। বৃদ্ধের দেখা সেই রকম। নদী ও নারী, বনের রাজা, মঙ্গল গ্রহ, সমুদ্র, সামনে চামেলি, তারিনীর বাড়ি বদল, চোর, খালপোল ও টিনের ঘরের চিত্রকর, রাইচরণের বাবরি... কত গল্পের কথা বলব। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী আমাদের সাহিত্যে ছোট গল্পের এক বিরল শিল্পী। আমাদের মনের আলো অন্ধকার, যৌনতা ও রূপ অরূপের, সৌন্দরযের নানা অনুষঙ্গের রূপকার। তাঁর গল্প পড়ে জীবনের অতিসূক্ষ্ম মুহূর্তগুলোকে আমরা অনুভব করতে পারি। স্থুল কাহিনীর রূপকার ছিলেন না তিনি। বাংলা সাহিত্যে তাঁদের দাপটই তো বেশি ছিল সেই সময়। তার পরিবর্তন খুব বেশি হয়েছে বলে জানা নেই।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গল্প ব্যর্থ মানুষদের নিয়ে। আবার তারাই জীবনের রূপ-অরূপকে চিনতে পারে। অনুভব করতে পারে। ‘সামনে চামেলি’ গল্পের ক্রাচ বগলে সেই যুবকটির কথা মনে করুন। সে দেখেছিল রূপ, রূপের আকর্ষণে সেই নির্জন পথে একা একা হেঁটে যেত। তাকে তো ভিখিরি ভেবে ব্যালকনি থেকে পয়সা ছুঁড়ে দিয়েছিল সেই রমণী। এমন অনুভূতিপ্রবণ লেখক আমাদের ভাষায় খুব কমই এসেছেন। ১৯৭৫-৭৬ এ, সেই আমাদের আরম্ভের দিনে তাঁকে আমি দেখেছি কলেজ স্ট্রিটে। অধুনা লুপ্ত পুস্তক প্রকাশনী নামের এক প্রকাশন সংস্থার কর্ণধার কণকবরণ মিত্র ছিলেন তাঁর গভীর অনুরাগী। সেখানে কোনো কোনো বিকেলে এসে বসতেন তিনি। তাঁর সন্তানবৎ আমরা তাঁর সামনে বসে থাকতাম। তাঁর নতুন গল্পের কথা শুনতাম। সাহিত্যের নানা কথা পছন্দ অপছন্দের কথা তিনি বলতেন। নানা লেখকের কথা। আমাদের হয়তো জিজ্ঞেস করতেন কী দেখছি, লেখার কথা ভাবছি কী রকম। এখন সমস্তটাই অলীক মনে হয়
এই জীবনে কি ঘটেছিল তা? এই যে অনেকদিন বাদে আবার পড়লাম ‘রাইচরণের বাবরি’। এতকাল বাদে পড়তে পড়তে কি মনে হচ্ছে না তিনি মৃদু গলায় আমাকে বলছেন, আমি যা দেখিনি তা অনুভব করতে পারিনি, তা লিখিও নি, অনুভবের বাইরে পারিনি লিখতে। কল্পনারও তো একটি পরিসর থাকতে হবে। শুনতে শুনতে সামনে চামেলি গল্পের কথা, তা থেকে রাইচরণের বাবরি গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, একটা কথা না বললে নয়, কলেজ স্ট্রিটে ৫০ বছরের পুরনো প্রকাশকের ঘরে যখন দেখি না বিক্রি হওয়া পুরোন বইয়ের ধুলো, আচমকা তাঁর ছাতা গল্পটি মনে পড়ে যায়। সেই ভাগীরথি প্রকাশনী, ঠিক দুপুরে খরিদ্দার নেই দোকানে, তখন মেঘলা আকাশ বইয়ের লেখকের আগমন। বই তার চলেই না। প্রকাশনীর কর্মচারীর পুরোন ছাতা নিয়ে এই অসামান্য গল্প...। আমি দেখতে পাই মন-গহনে বিচরণ করা সেই লেখককে।
রাইচরণের বাবরি ছিল খুব বাহারের। সে একটা দরজির দোকানের মালিক। একটা পা মেসিন, খুপরি ঘর, শিয়ালদার রাস্তা যেখানে বউবাজারের রাস্তায় বেঁকেছে, সে ভিড় জমজম জায়গায় বাবরি দুলিয়ে রাইচরণ সেলাই করে ( হ্যাঁ, সেই রাস্তার বাঁক এখন অন্তর্হিত, দৈত্যাকার ফ্লাইওভার বিহীন সেই পুরোন কলকাতা আছে এই সব গল্পে)। বাবরি নিয়ে রাইচরণের খুব গর্ব। তার বাবরি দেখে পাড়া-প্রতিবেশী মুগ্ধ। পথ চলতি মানুষ মুগ্ধ। সেলাই মেসিনে পা চলছে খলিফার, তার মাথার কালো কুচকুচে থাক থাক বাবরি দুলছে। ব্যস্ত-সমস্ত পথচারীর চোখ পড়ে গেলে দাঁড়াবেই। তারপর আলাপ করবার উদ্দেশে ভিতরে প্রবেশ করে হয়তো সেলাইয়ের অর্ডার দেবে। তা হয়ও। বাবরি তাকে খরিদ্দার এনে দেয়। বাবরি নিয়ে এত গর্ব রাইচরণের, কিন্তু তার বউ দেখতে পারে না ওই চিতাবাঘের জঙ্গল। রেগে বলে, বটি দিয়ে চুলের গোড়া সুদ্ধ কেটে দেবে। একদিন সুযোগ পেলে, দেশ্লাইয়ের কাঠি জ্বেলে পুড়িয়ে দেবে। রাইচরণ হাসে। সে বাবরিকে পরিচর্যা করে স্নানের আগে। বাঁ হাতের তেলোয় এতখানি তেল গবগব করে ঢেলে সামনে আরশি নিয়ে আধ ঘণ্টা ধরে তেল মাখায় বাবরিকে।
মানদা বলে, কী হবে ওই বাবরি দিয়ে, তেল খরচ করে, তার কতদিনের সাধ শশীর বউয়ের মতো একটা স্কারট পাড় শাড়ির, হলো কই ? রাইচরণ চুপ করে থাকে। সত্যিই তো, তার যদি বাবরি নিয়ে এমন আহ্লাদ থাকে, মানদারই বা ঐ স্কারট পাড় শাড়ির শখ থাকবে না কেন ? তাদের ছেলেমেয়ে নেই। রাইচরণ জানে তার বাবরি তার দোকানের হাল ফেরাবে। বাবরি তো খরিদ্দার আনে তার দোকানে। হ্যাঁ, তা হয়। একদিন সেই নিরিবিলি দোকানে একটি ফিটফাট বাবু এসে ঢুকল। বাবু অর্ডার দিল না, কিন্তু কথায় কথায় রাইচরণের ঠিকুজি জেনে নিয়ে বলে, এইসব দর্জির কাজ তাকে মানায় না, দোকানে বসে কল চালাতে হিমসিম খাচ্ছে রাইচরণ, অথচ ওই চুল দিয়ে সে দেশজোড়া নাম কিনতে পারে। থিয়েটার কোম্পানির ম্যানেজার লোকটি ১০০ টাকা মাস মাইনের প্রস্তাব দিল তাকে। শুনে রাইচরণ হতভম্ব, তার সাতপুরুষে কেউ যাত্রা থিয়েটার করেনি, সে পারবে না। কিন্তু ম্যানেজার নাছোড়বান্দা। পরেরদিন আসবে বলে গেল।
রাইচরণ যাবে না ঠিকই করেছিল, কিন্তু মানদাকে কথাটা বলেই সে ভুল করল। মানদা বলল, না গেলে রাইচরণ ঘুমোলে তার চুল নিকেশ করে দেবে সে। ১০০ টাকা কে দেয়? খলিফাগিরি করে কত হয় রাইচরণের ? অগত্যা যেতে হয় ১০০ থেকে বেড়ে ১২৫ টাকা মাস মাইনেতে। দোকানে তালা ঝুলিয়ে রাইচরণ গেল। রাইচরণের বাবরির এত দাম তা সে কি জানত? সে থিয়েটার কোম্পানির নতুন এক পালায় এক ডাকাতের রোল পেয়েছে। রাইচরণ ধন্ধে পড়ে। সে তো ডাকাত হয়ে নামবে মঞ্চে, কিন্তু সে তো সত্যিকারের ডাকাত নয়? ম্যানেজার বলল, তা হবে কেন, তাকে মঞ্চে উঠে বইয়ের কথা কটা বললেই হবে।
আসলে সব মিথ্যে। ডাকাতের সাজ-পোশাক, কথাবার্তা, লুঠতরাজ—সব। দর্শকও জানবে তাই। তারা শুধু সাময়িক ভাবে ধরে নেবে যেন সত্যি এক ডাকাত তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাইচরণ ছেড়ে এলো কাজ। কেন না, তার সবটাই যখন মিথ্যে বলে ধরে নেবে দর্শক, যেখানে সাজ-পোশাক, হাব-ভাব, কথাবার্তা সব মিথ্যে বলে জানবে দর্শক, বাবরিটা আলাদা ভাববে কেন? ভাববে নিঘঘাত ওটা একটা পরচুলা। তাতে তার সাধের বাবরির মান যায়। বাবরি তার অতি যত্নের। তাকে সে অসম্মান হতে দেবে কেন? ১২৫ টাকা মাস মাইনের দামি কাজ ছেড়ে রাইচরণ ফিরে এল তার সেলাই মেসিনে। ওই টাকার চেয়ে তার বাবরির দাম তার কাছে অনেক বেশি। রাইচরণ কি শিল্পী ? শিল্পী তো নিশ্চয়। সে তো রূপ-অরূপ চেনে। চেনে সৌন্দর্য। শিল্প। মনে মনে সে সত্যিকারের আর্টিস্ট। বাবরি তার যত্নে রাখা পরম ভালোবাসার জিনিস। সৃষ্ট শিল্প যেন। তার অপমান সে সহ্য করে কী করে? এই হলো আমার প্রণম্য লেখকের গল্প।