নজরুল জন্মজয়ন্তী
ক্ষুদ্র প্রেমের শূদ্রামি
শুরুতেই বলে নিই, এই লেখা কোনো ভক্ত, বিদ্বেষী বা বিশেষজ্ঞের নয়। যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বা মৃত্যুদিন, তখন এই বঙ্গে আলোড়ন জাগে [মাফ করবেন ‘এই বঙ্গে’ বলাতে কষ্ট পাবেন না, আমি বঙ্গ হিসেবে বাংলাদেশকেই মানি]। মনে পড়ে নজরুল আমাদের ‘জাতীয় কবি’, যদিও ব্যাপারটা এখনো অলিখিত [!]। তবু আমরা শামিয়ানা টাঙিয়ে, চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে ও মাইক বাজিয়ে শ্রদ্ধা ভক্তি আবেগ পাণ্ডিত্য এবং সর্বোপরি বরাদ্দ অর্থ খরচ করে ফেলি। এরপর আমরা শূন্য, সব দিক থেকেই। সব দিক? মানুষের অনেক দিক থাকে; রাষ্ট্রের দিক অজানা। আরেক জ্বালা তৈরি করেছে আর্ট আর ইন্ডাস্ট্রি মিলেমিশে—দেখুন দুটোই শিল্প! একে খাবেন না ফেলবেন ভাবতে ভাবতেই হজম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থাতেও লেখার সাহস থাকে কী করে? মানতেই হবে এও এক তালে-গোলমালের বরাদ্দ!
কাকের বাসায় কোকিল সুযোগ বুঝে ডিম দেয়, এই বিষয়টা এখন সময় দিয়ে নয়, প্রবৃত্তির মূল্যে বুঝি আমরা। চারপাশের এত বুদ্ধিমান মানুষের মধ্যে নজরুল ইসলামের মতো এমন সরল প্রাণখোলা জীবনবাদী জীবনবাজি-রাখা মানুষ কেমন করে এসে উপস্থিত হলেন তা নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। নজরুলের মাজারের খাদেমদের নিকট নিশ্চয়ই বাছা বাছা মোক্ষম উত্তর আছে, তাঁদের অন্তরের সোনার কাছিম নিশ্চয়ই আরো উত্তর তৈরি করছে! নজরুল যখন যুদ্ধের বাতাস নিয়ে অথবা বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ সাঙ্গ করে কলকাতার সাহিত্যের বাজারে অবতীর্ণ হলেন, সম্ভবত বুদ্ধিমান মানুষগুলোই তাঁকে নিত্তির দুই পাল্লাতেই চাপিয়ে দিয়ে খেলা দেখতে নয়, সদাই বিক্রি করতে বসে গেলেন। বলছি হিন্দুর কথা, মুসলমানের কথা—বাজারের টানে তাঁরা নজরুলকে ভাবনার সুযোগই দিলেন না। হয়তো বাটপার বিপ্লবীরাও ছিল সুযোগের অপেক্ষায়! লেটোর দলের ঘুঙুর পরা বালক ধুরন্ধর টুপি-টিকির মাথায় মাথায় নাচবার সুযোগ পেল, ইনকিলাবের ঢেউয়ে ভেসে বেড়াতে পারল কিংবা বন্দে মাতরমের ভাবী গর্ভে দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জনও করতে পারল। কারো মিষ্টি কথায়, কারো চায়ের আদরে অথবা দলবাজির খপ্পরে নজরুল সরল বলেই পড়লেন।
স্বার্থে ও সংস্কৃতিতে সম্পর্ক কোথায়? আসলে স্বার্থই সংস্কৃতি তৈরি করে; কেবল ক্ষুদ্র বা বড়ত্ব নিয়ে নিজের দিকে ঝোল টানার হাঙ্গামা বাদ দিলে। নজরুলকে নিয়ে অতীতেও স্বার্থ ও ক্ষুদ্রত্বের সমস্যা ছিল, আজকেও তার রকমফের আছে। আমরা কি তা বুঝি? হয়তো বুঝি, বেশিরভাগই হয়তো বুঝি না। এ জন্যই হয়তো নজরুল নিয়ে আলোচনা এখনো জমেনি, যতটা জলশা জমেছে। এখনো নজরুলকে নিয়ে টিকি ও টুপির দৌরাত্ম্য আছে; তারা নিজের মতো প্রমাণ হাজির করতে ব্যস্ত।
কিছুকাল আগেও, হয়তো এখনো অনেকে নজরুলের সমাধিস্থলকে বলেন ‘মাজার’। এই ধারার পণ্ডিতদের হুমায়ুন আজাদ বলতেন, ‘নজরুলের মাজারের খাদেম’। এর শুরুটা কোথায় ছিল? পেছন দিকে খুঁজে গেলে দেখতে পাব আমাদের মনের গুহা। দারিদ্র্য, লেটোর দল, যুদ্ধে যাওয়া, বাউণ্ডুলেপনা, অতিরিক্ত আবেগ, হিন্দু-মুসলমানের ভাগাভাগি, রাজনীতি ও অখণ্ড বাণিজ্যের দখলদারি সব মিলিয়ে একজন নজরুলকে এখন আর কেউ খুঁজতে যায় না। আমাদের মনের প্রয়োজন নজরুলের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছি, ব্যবহার করছি প্রতীকের মতো। মূলত এরই গভীরে আছে বিচ্ছিন্নতার সূত্র। নজরুল এখন বিমূর্ত; তাঁকে গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের বা জাতিগত আদর্শে তৈরির চেষ্টা চলছে। আমাদের একজন রাজনৈতিক নেতা আছেন, আমাদের এ জন্য একজন সামরিক নেতা লাগবে; আমরা একজনের গান গাই অটল দাঁড়িয়ে, আমাদের আরেকজন লাগবে যার গান হাঁটতে হাঁটতে গাইতে পারব; আমাদের একজন জলে-মাটিতে মাখামাখি থাকলে, আরেকজন লাগবে মরুভূমির। আরো গোপন কথা হয়ত আছে—পাপের ভয়ে সেই কথা এখন না বলি!
কান পাতলে, আসা-যাওয়ার পথে অথবা টেনে নিয়ে যাওয়া জলশায়, পরে যা লিখছি সেই কথাগুলো শোনা অসম্ভব নয় : কাজী নজরুল ইসলামই বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি, যিনি শব্দ-রূপকল্পে রাজনীতিকে ধারণ ও আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। তিনিই প্রথম কাব্যিক অহংকারে রাজনীতিকে ব্যবহার করতে লজ্জিত হননি, তাঁর পেশিকে গোপন করেননি, বুক খুলে দাঁড়িয়েছেন প্রতিরোধের প্রথম কাতারে। অসত্য নয়। ভাবছি কে বলছে কথাগুলো? অথবা হিন্দু-মুসলমান শব্দ দুটি ব্যবহার করেই বলছি তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন! আমরা কি প্রমাণ করতে চাইছি, কবি হিসেবে নজরুল ইসলাম একমাত্র অসাম্প্রদায়িক? আসলে বাণিজ্যবুদ্ধিই সর্বাপেক্ষা অসাম্প্রদায়িক। তাঁকে মসজিদের পাশে কবরের করবার যাঁরা হর্তাকর্তা ও অনুসারী, তাঁরাই এখন ৩৬৩ বা ৩৬৪ দিনের বিশেষজ্ঞ। রাষ্ট্র চাইলে বাকি দুদিনও তাঁরা চেয়ার দখল রাখেন।
আমার যা বলার বলে ফেলেছি, বলেছি উপরের পথে নজরুল ইসলাম থাকতে পারেন না, চলতেও পারেন না। নজরুল মনে রেখেছিলেন কবিতা স্বর্গীয় কিছু নয়, লোকসমাজের ব্যবহারের কিছু, প্রয়োজনে কৃষকের লাঙল-কাস্তে বা শ্রমিকের হাতুড়ির-গাইতির মতোই। জীবনের পরিচিত বা অপরিচিত পথ আছে, এতে চলতে হলে বাহন প্রয়োজন পড়ে; এই নদীর দেশে ঋতুভেদে বাহন পাল্টাতে হয়; আবার মাঝির গানের সঙ্গে গাড়োয়ানের গানের পার্থক্য আছে। সময় তাই নজরুলকে পথ করে দিয়েছে, তিনি প্রতিবেশের গুণে যুক্ত করেছেন নতুন সুর। উদাসীনতা, উন্নাসিকতা বা স্বার্থপরতা তাঁর স্বভাব নয়; ইন্ডাস্ট্রির ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করেনি তাঁর কবিতার আকাশ। আর যদি দহনের প্রসঙ্গ আসে, তবে তাতে উত্তাপ থাকবেই, তা গোপন করার কোনো সুযোগও নেই। এখন সেই উত্তাপের চাহিদা ও অনুভব জরুরি। আমরা কি নিজেদের পোড়াতে প্রস্তুত? যাদের হাতে মাইক আছে তারা যে প্রস্তুত নয়, সে কথা বুঝতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় সেই মানুষগুলোকে অস্বীকার করলে। এভাবে জেগে উঠবেন নজরুল ইসলাম।