গল্প পড়ার গল্প
আকাশ থেকে গল্প নামাতেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র
নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে দেখতে দেখতে আমি বড় হয়েছি। ধুতি আর খুব সম্ভবত শাদা আরদির পাঞ্জাবি পরা নরেন্দ্রনাথকে আমি দেখেছি পাইকপাড়ার দিক থেকে হেঁটে আসছেন বেলগাছিয়ার রাস্তায়, একা একা, নিজ মনে। তাঁর রস, শ্বেতময়ূর, পালঙ্ক, এক পো দুধ, টিকিট, চিলেকোঠা, বিলম্বিত লয়—এই সব গল্পের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে ধীরে ধীরে। কত তুচ্ছ ঘটনা, কত তুচ্ছ মুহূর্ত থেকেই না তিনি গল্প বের করতে পারতেন। আর সেই গল্প হত কী অনুভূতিময়। পাঠক আপনি ‘টিকিট’ গল্পটির কথা স্মরণ করুন। ছেলেটির অভ্যাস প্রতিদিন বাবা বাড়ি ফিরলে টিকিটটি সংগ্রহ করা। ট্রামে টিকিট ফাঁকি দিয়ে বাড়ি ফিরেছিল বাবা। বাড়ি ফিরে শিশু সন্তানের হাতে ধরা পড়ে যায় ট্রামের টিকিটে দুপয়সা বাঁচিয়ে তৃপ্ত বাবা।
শ্বেতময়ূর গল্পে দাদার বন্ধু জার্মান যুবক কদিন অতিথি হয়েছিল তাদের বাড়ি। কিশোরী মেয়েটি জানে না সেই যুবকের মনে প্রেমের সঞ্চার হয়েছে তার প্রতি, যেমন হয়েছিল তারও। যাওয়ার দিন সেই জার্মান যুবক নিজের ভাষায় তার যে আবেগ প্রকাশ করল তা কিশোরী মেয়েটির মন দুমড়ে দিল। প্রেমের ভাষা কেউ চিনতে ভুল করে না। একজন জার্মান, অন্যজন বাংলায় কথা বলে যাচ্ছিল। বাংলা ভাষায় এমন প্রেমের গল্প আমরা খুব কম পড়েছি। আমি বলছি অন্য এক গল্প “ রানু যদি না হত “র কথা। নরেন্দ্রনাথ ছিলেন অসামান্য গল্প বলিয়ে। তাঁর মতো গল্প কথক আমাদের সাহিত্যে আর আসেননি। নরেন্দ্রনাথের গল্প পড়তে পড়তে মনে হয় তিনি যেন আকাশ থেকে গল্প নামিয়ে আনতেন। তিনি যেন প্রাচীন কালের গ্রামবৃদ্ধের মতো শোনাতে পারতেন কতকালের পুরোনো সব কাহিনী।
হ্যাঁ, নরেন্দ্রনাথের শতবর্ষ পার হলো, ১৯১৬ সালের জানুয়ারিতে তাঁর জন্ম। বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম, অসামান্য সব গল্পের জনক। রস, পালঙ্কর মতো গল্প আমাদের ভাষায় কেন বিশ্ব সাহিত্যে কম লেখা হয়েছে। বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুর যৌথ জীবন যাপনের অপূর্ব সব কাহিনী তাঁর কথনে খুঁজে পাই। আমি বলছি অন্য একটি অচেনা গল্পের কথা। কলকাতা শহরে কায়ক্লেশে বেঁচে থাকা নিম্নবিত্তের জীবনের এক আশ্চর্য কাহিনী শোনাই।
‘রানু যদি না হত’ এই শহরের এক সতের বছরের মেয়ে রানুর গল্প। এই শহর মানে এই ২০১৩-এর শহর তো নয়। সেই শহর আমার ছেলেবেলার। ষাটের দশক হতে পারে। পঞ্চাশের দশকও হতে পারে গত শতাব্দীর। তারপর পৃথিবী অনেকখানি পথ পার হয়েছে। পুরোনো ধ্যান ধারনা বদলে গেছে অনেক। নরেন্দ্রনাথ তাঁর চারপাশের মানুষের মুখ আঁকতেন নানা রঙে। আমি বারবার মৃদুভাষী, আত্মমগ্ন এই লেখককে দেখে আপ্লুত হয়েছি। রানুর গল্পটি এক আত্মমগ্ন মেয়ের গল্প। নিতান্ত মধ্যবিত্ত কেরানি বাবার কন্যা রানু। কলেজে পড়ে। মা থাকে প্রায়ই অসুস্থ। রানুকে সব দেখতে হয়। সে তো মা বাবার প্রথম সন্তান। তার পরে আর এক বোন বুলু, দুইটি বালক ভাই। নরেন্দ্রনাথ যে নিম্নবিত্তের সংসার আঁকেন, সেই সংসারেই আমরা বড় হয়েছি। এই বয়সে তাঁর গল্প পড়তে গেলে সেই কলকাতা সেই ছোটবেলাকে দেখা যায়।
রানুর মায়ের অসুখ, জ্বর। বুড়ো ডাক্তার বলেছে বিকেলে এসে মিকশ্চার নিয়ে যেতে। ডিসপেন্সারিতে মিকশ্চারের শিশি রেখে রানু কলেজে গেল, ফিরল সাড়ে চারটে নাগাদ সেই বুড়ো ডাক্তারের ডিসপেনসারিতে। ডাক্তার বিকেলে থাকে না। থাকে যে কম্পাউন্ডার সেও বুড়ো। এই ডিসপেনসারি তাদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূর, এর চেয়ার টেবিল থেকে সমস্ত ফারনিচার পুরোনো। এখানে যে কেন আসে বাবা মা বার বার। বুড়ো ডাক্তারের বুড়ো কম্পাউন্ডার নেই। তার টেবিলে রানুর রেখে যাওয়া শিশিটি রয়েছে। রানু বসে আছে। ডিসপেনসারিতে আছে বুড়ি ধাই সারদা। সে বন্ধ ঘরে এক গরিব বউয়ের গর্ভ পরীক্ষা করছে। পাঁচটা বাজল, তারপর ঢং করে সাড়ে পাঁচ। রানু ভেবেছিল মিকশ্চারের শিশিটি নিয়ে সে যাবে তার বন্ধু হেনার বাড়ি। সেখানে হেনার মামাতো দাদা সুনীল আসবে। অপেক্ষা করবে রানুর জন্য। কিছুই হবে না। হতাশ বিরক্ত রানু যখন চলে যাবে ভাবে, ধাই বুড়িকে সেই কথা বলতে সে রানুর হাত ধরে ফেলে। আর একটু বস। কম্পাউন্ডার এসে যাবে। বুড়ি তার কাছে বসা গরিব সেই গর্ভবতীকে বিদায় দেয়। তার শাড়ি ব্লাউজ দেখে রানু ভাবে কী করে বেরোয় এরা এই ভাবে পথে। বুড়ি দাই বলে, হবে হবে, আর ক’বছর বাদে রানুও এমন সুখ নিয়ে আসবে তার কাছে। না তার কাছেই বা কেন, হাসপাতালে যাবে। দাইয়ের কাছে কে আসে এখন ? রানু লজ্জা পায়।
বুড়ি বলে, তার হাতেই জন্ম হয়েছিল রানুর। সে-ই খালাশ করেছিল তাকে। জানে রানু তা। বাড়িতেই শুনেছে সে কথা। কিন্তু এরপর বুড়ি যা বলে তার জন্য রানু প্রস্তুত ছিল না। বুড়ি বলছে, রানু তো জন্মাত না, শুধু মেয়েমানুষের জান বলে আসতে পেরেছে। সে আবার কেমন কথা? রানু কৌতুহলী হয়। বুড়ি কথাটা ভাঙতে শুরু করে ধীরে ধীরে। সে সতের বছর আগে এক দুপুরে এই ডাক্তারখানায় রানুর ঠাকুরদা এল হাঁপাতে হাঁপাতে। কী হয়েছে, না তার তিন মাসের পোয়াতি বউমার রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তার বোধ হয় সব্বোনাশ হয়ে গেল। ডাক্তার আর ধাই ছুটল সেই বাড়ি। দেখল সত্যি। ধাই তো সব বোঝে। ডাক্তার চিকিৎসা করে বাঁচাল বউকে আর তার পেটেরটাকে। কিন্তু হল কেন অমন ? আসলে কী হয়েছিল, বুড়ি ধাই বলে, ওষুধ খাইয়ে প্রসূতি বউয়ের ওই অবস্থা করেছিল বউয়ের স্বামী। রানুর বাবা। ডাক্তারের জেরায় সে গোপনে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল, তার চাকরি নেই, বউকে সে পড়াবেও ভেবেছে, এখন সন্তান হলে খুব অসুবিধে হয়ে যাবে ভেবেছিল, সন্তানটিকে নষ্ট করতে চেয়েছিল সে।
রানু জানল, সে না আসতেও পারত। তাকে মা বাবা চায়নি সে আসুক, তবু সে এসে গেছে। রানু কেমন শূন্য হয়ে গেল। এ পৃথিবীতে তার না আসবার, না থাকবারই কথা ছিল। কিন্তু সে আছে। সন্ধ্যেবেলায় লোকজনে ভরা শহরের পথ দিয়ে এই যে সে হেঁটে চলেছে, এই চলবার কোনো কথা ছিল না। আজকের রানু যেন এই পৃথিবীর মেয়ে নয়। সে তো জন্মাতই না। প্রতিদিনের অভ্যাসে বাড়ি ফেরা রানু আজ বিরক্ত বাড়ির ওপর। মায়ের কাছে গেল না অভিমান আর রাগে। তাকে চায়নি মা বাবা। এই গল্প ক্রমশ নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারের দীনতার ভিতরে ঢুকে পড়ে। বাবা হেমাঙ্গ বাড়ি ফিরে রানুর কাছে খোঁজ নেয় তার কী হয়েছে যে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে? তারপর হেমাঙ্গ বেরোয় টাকা ধারের জন্য হাতিবাগানের দিকে। মাসের শেষ যে। রানুর দুই ভাই, বাড়ির দুই বালক খাওয়া নিয়ে বায়না করে। শুধু ডাল-ভাত খেতে চায় না। রানুর পরের বোন বুলু জেরবার। রানুর মা, অভাবী সংসারের অসুস্থ গৃহিণী অপারগ স্বামীর প্রতি অভিযোগ জানায় নিজের মনে, খেতে দিতে না পারলে জন্ম দেওয়া কেন? মায়ের আক্ষেপ, ভাই দুটির না মেটা ক্ষুধার বাস্তবতা রানুকে ধীরে ধীরে নিজের স্বত্বার কাছে ফেরায়। সে ঘরের অন্ধকার থেকে বেরোয়। তাদের শোয়ার ঘর আর রান্না ঘরের মাঝখানে একফালি উঠন। তার উপরে তারায় তারায় ভরা আকাশ। রানু অনুভব করে, সে না এলে এই বিরাট আকাশ আর বিপুলা পৃথিবীর হয়তো কিছুই এসে যেত না। কিন্তু সে যখন কোনো না কোনো ভাবে একবার এসে পড়েছে, তখন এর চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে। এই গল্প ফিরে ফিরে পড়ি। নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে প্রণাম।