ঘনঘোর বরিষায়
এমন দিনে মন খোলা যায়
এই বাংলায় বর্ষা আসে গায়ে মেঘের ঘনঘোর আবির মেখে রিমিঝিম নূপুর পায়ে। প্রেয়সীর বিরহ-বিচ্ছেদকে কারুণ্যে ভিজিয়ে দিয়ে এক অন্য বিমোক্ষণের নেশা পাইয়ে দিতে বর্ষার সাড়ম্বর আবাহন সর্বত্র বড় সার্থক হয়ে বাজে। শীত গ্রীষ্ম পেরিয়ে এসে বছরজুড়ে এই ভূমি ও ভূমিপুত্রের দেহমনে যে কলুষ জমা হয় তা ধুয়ে সাফসুতরো ও পরিশুদ্ধ করতেই যেন বারবার ফিরে ফিরে আসে আষাঢ় ও শ্রাবণ। চাতকীয় প্রাণ-প্রকৃতির কাছে সে হয়ে ওঠে প্রিয় প্রাণেশ। ধ্যানমগ্নতায় নিজের মধ্যে ডুব দেওয়ার সময় তো এই বর্ষা আর শ্রাবণই। ঝরো ঝরো বৃষ্টির এই সময় প্রকৃতিতে যে গান বাজে, সমস্বরে বাজে তা বাদলে ভেজা বিমুগ্ধ প্রেমিকপ্রবরের প্রাণে, চিন্তায় ও চেতনায়। নিমগ্নতায় আপনাকে আপনার মাঝে ফিরে পাওয়ার দিন বর্ষা। উজার করে মন খুলবার দিন মেঘলা আকাশ শ্রাবণ। বাস্তবতায়, সাহিত্যে বা সংস্কৃতিতে প্রকৃতির সব সন্তানের কাছে অতি আরাধ্য তাই সজল ঘন বর্ষা!
সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ বর্ষাকাব্য কালিদাসের ‘মেঘদূত’ প্রাচ্য সাহিত্যের বর্ষাবন্দনার আদি নিদর্শন। কর্তব্য ভুলে প্রভুর অভিশাপে রাজা যক্ষকে রামগিরি পর্বতের বিজন আশ্রমে নির্বাসিত হতে হয়। সেখানে বসে আষাঢ়ের প্রথম দিনে নববর্ষার মেঘ দেখে তারই মাধ্যমে অলকাপুরীর রম্যপ্রাসাদে তাঁর বিরহী প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বার্তা প্রেরণ করবেন বলে মনস্থির করেন যক্ষ। মেঘের কাছে তাঁর বিরহী প্রিয়ার রূপলাবণ্য বর্ণনা করে অলকায় পৌঁছানোর ভূগোল বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে মেঘকে অনুরোধ করেন প্রিয়তমাকে তাঁর কুশল সংবাদ নিবেদন করতে।
অনুরাগের গভীরতায় অনুভব করা যায় কালিদাসের বর্ষাকে। যেখানে মেঘের সাথে প্রেম ও বিরহের সম্বন্ধ পাতিয়ে সৌন্দর্যসখা মেঘকে যক্ষের প্রিয় সহচর করে বার্তাবহরূপে যক্ষপ্রেমিকার কাছে পাঠান। কালিদাস লিখেন : কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে/ যদি না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গলবার্তা?/ মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে!
পুরাকালে ভারতবর্ষের সাহিত্যে কবিরা বর্ষাকালকে বিরহ ও বিবাগী কাল হিসেবেই বিবেচনা করতেন। কারণ এতদাঞ্চলে বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে পথঘাট ও মাঠপ্রান্তর বর্ষার জলে ডুবে যেত। চলাচলের জন্য সে রকম কোনো যানবাহন তখন ছিল না। কর্মযজ্ঞে দূরে থাকা প্রবাসী স্বামীরা বর্ষা নামার আগেই বাড়ি ফিরতেন; না ফিরতে পারলে সাত-আট মাসের বিরহ বঞ্চনাকে সাথী করে নিঃসঙ্গতায় সময় কাটাতে হতো তাঁদের। পদাবলি সাহিত্য ও বৈষ্ণব কবিতায় বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের মতো কবিরা তাই বর্ষাকে এঁকেছেন বিরহ আর অভিসারের রূপকল্পনায়। বিরহ কাতর চণ্ডীদাস কবিতায় লিখেন-
এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা/কেমনে আইল বাটে
আঙ্গিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছে/দেখিয়া পরাণ ফাটে।
চণ্ডীদাসের সুরকে সারথি করে উনবিংশ শতাব্দীতে মাইকেল মধুসুদন দত্ত তাঁর রচিত ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার রূপকল্প বর্ণনা করেন এভাবে :
গভীর গর্জন করে সদা জলধর/উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর
রমনী রমন লয়ে/সুখে কেলি করে /দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্দরে।
বর্ষাকে কবিতা ও গানে নানা রূপে এঁকেছেন কবি নজরুল ইসলাম। বর্ষার বাদল দিনে দয়িতা দূরে থাকলে দু’হাতে আঁখিযুগল ঢেকে কার না গুনগুনিয়ে গাইতে ইচ্ছা করে :
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে।
কিংবা-
আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে
হায় কী মনে পড়ে মন এমন করে।
হায় এমন দিনে কে নীড়হারা পাখি
যাও কাঁদিয়া কোথায় কোন সাথিরে ডাকি।
অনন্ত প্রেম আর শৌর্যময় দ্রোহের কবি নজরুল বাদর মুখর দিনে নিদ্রা যাচনা করেন না। তিনি তাঁর আকাঙ্ক্ষিত প্রেয়সীকে দুই চোখের তারায় রাখতে চান। তাই তো তিনি কাব্য করেন এভাবে :
অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে।
নিদ্রা নাহি তোমায় চাহি আমার নয়ন-পাতে॥
অন্যদিকে প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার শ্রাবণ দেখে বড় বিস্ময়াভিভূত হয়েছেন। জলভরা যৌবনা নদীর কাছে সুর শুনতে চেয়েছেন তিনি :
বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ/ চেয়ে রবে; ভিজে পেঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে/ শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প-ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে।
আর আমাদের আধুনিক কবি শামসুর রাহমান বৃষ্টির পিয়াসায় ‘অনাবৃষ্টি’ কবিতায় উচ্চারণ করেছেন :
টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়
ব্যঘ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়,
যদি জড়ো হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল বৃষ্টি...।
তবে বাংলা সাহিত্যে অনন্য অনিন্দ্যতায় বর্ষা আর শ্রাবণ সবচে’ বেশি ধরা দিয়ে রবীন্দ্রমানসে। তাঁর রচনাকর্ম যেন বর্ষাবন্দনার আকরভূমি। পদ্মায় সজ্জিত বোটের ছাদে বসে বর্ষাযাপন এবং তা ভালোবেসে টুকে রাখবার ইতিহাস সাহিত্য সমঝদারসহ সর্বজন নন্দিত। ঋতুবিভাগের ভিত্তিতে গীতবিতানে ১১৫টি বর্ষার গান আছে। সেসব গানে আছে বিচিত্র অনুভূতির অনুরণন।
শ্রাবণের আহ্বানে মনের ঘরে যে বেদনা জমা রাখা আছে, সেই পুঞ্জিত বেদনাবাণী কাঙ্ক্ষিতকে বাদলের অন্ধকারে শোনাতে চান প্রেমের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর :
আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে
যে কথা শুনায়েছি বারে বারে।
আমার পরানে আজি যে বাণী উঠিছে বাজি
অবিরাম বর্ষণধারে।
রবিকবির মনে শ্রাবণ এক অনির্বচনীয় দোলা দিয়ে যায়। তাঁর ধরাতে অপার্থিব নাচন ওঠে। তিনি কালহারা এক অন্যকালের পানে ছুটে যেতে চান :
আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে
দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে,
ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে।
কবি প্রেমাস্পদের জন্য মন খোলে দিতে চান। সমাজ সংসার মিছে প্রমাণ করে দু’জন মুখোমুখি বসে বলতে চান পুনর্বার বারবার সেই বলা কথা। পান করতে চান নয়ন দিয়ে নয়নের সুধা। অনুভব করতে চান হৃদয় দিয়ে আরেক হৃদয় :
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়...
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে মন জেগে ওঠে। চঞ্চল সজল পবন বেগে উদ্ভ্রান্ত সেই মন যে কোথাও বসে না। মেঘমল্লার সারাদিন বৃষ্টির গান শুনতে শুনতে কারো চিরঋণে হৃদয় জড়াতে চান কবিবর:
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না ॥
মুখর বাদর দিনে কবি পরাণসখার অবহেলা কিছুতেই সইতে পারবেন না। বাদলবেলা উদযাপনে কবি দয়িতাকে আহ্বান করেন নীপ বনে ছায়াবীথি তলে নবধারা জলে স্নান করতে। তাল তমাল অরণ্যের ক্ষুব্ধ শাখাদের আন্দোলনে কবি শেষাবধি মেঘকে সঙ্গী করে উড়ে চলেন নিঃসীম শূন্যেঃ
মন মোর মেঘের সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে
রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম।
বাংলাভূমির বর্ষার বৈচিত্র্যময় চিরায়ত রূপমাধুর্য আঁকা আছে কবিগুরুর ‘বর্ষার চিঠি’ প্রবন্ধে। সেখানে তিনি বলেছেন, সকল বয়সেরই একটা কাল আছে। যৌবনের যেমন বসন্ত, বার্ধক্যের যেমন শরৎ, বাল্যকালের তেমনি বর্ষা। ছেলেবেলায় আমরা যেমন গৃহ ভালোবাসি এমন আর কোনো কালেই নয়। বর্ষাকাল ঘরে থাকবার কাল, কল্পনা করবার কাল, গল্প শোনবার কাল, ভাইবোনে মিলে খেলা করবার কাল।
ভরা পুকুর, আমবাগান, ভিজে কাক ও আষাঢ়ে গল্প মনে করুন। আর যদি গঙ্গার তীর মনে পড়ে, তবে সেই স্রোতের উপর মেঘের ছায়া, জলের উপর জলবিন্দুর নৃত্য, ওপারের বনের শিয়রে মেঘের উপর মেঘের ঘটা, মেঘের তলে অশথগাছের মধ্যে শিবের দ্বাদশ মন্দির স্মরণ করুন। মনে করুন পিছল ঘাটে ভিজে ঘোমটায় বধূ জল তুলছে; বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে, পাঠশাল ও গয়লাবাড়ির সামনে দিয়ে সংকীর্ণ পথে ভিজতে ভিজতে জলের কলস নিয়ে তারা ঘরে ফিরে যাচ্ছে; খুঁটিতে বাঁধা গোরু গোয়ালে যাবার জন্যে হাম্বারবে চিৎকার করছে; আর মনে করুন, বিস্তীর্ণ মাঠে তরঙ্গায়িত শস্যের উপর পা ফেলে ফেলে বৃষ্টিধারা দূর থেকে কেমন ধীরে ধীরে চলে আসছে; প্রথমে মাঠের সীমান্তস্থিত মেঘের মতো আমবাগান, তার পরে এক-একটি করে বাঁশঝাড়, এক-একটি করে কুটির, এক-একটি করে গ্রাম বর্ষার শুভ্র আঁচলের আড়ালে ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে আসছে, কুটিরের দুয়ারে বসে ছোটো ছোটো মেয়েরা হাততালি দিয়ে ডাকছে ‘আয় বৃষ্টি হেনে, ছাগল দেব মেনে’—বর্ষার দিনে আমাদের ছেলেবেলার কথাই মনে পড়ে।
মার্কিন কবি হেনরি ওয়ার্ডস ওয়ার্থ লংফেলো তাঁর রচিত ‘The Rainy Day’ কবিতায় যেমনটা বলেন :
My life is cold, and dark, and dreary;
It rains, and the wind is never weary;
My thoughts still cling to the mouldering past,
But the hopes of youth fall thick in the blast,
And the days are dark and dreary.
সাহিত্যের নন্দনতত্ত্বে বর্ষা আর শ্রাবণ এক অবিনাশী ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেখানে আছে প্রেম ও বিরহে উদযাপন, অর্চনা আর হারিয়ে ফেলা সুশোভন অতীতকে ফিরে পাবার আকুতি। এ কালের জলজটের বিড়ম্বনার দায় কিছুতেই বৃষ্টির নয়; দায় বেভুল মানুষের। আমাদের কণ্ঠে তাই শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতেরই স্বতঃস্ফূর্ত আরাধনা।