রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে সমাজ ও রাজনীতি
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বাঙালির চিরায়ত ভক্তিরসে নিষিক্ত ছিলেন তিনি, ছিলেন মানবতাবাদী। তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দিয়ে তিনি মানুষের অন্তর্গত জগৎকে যেমন নাড়া দিয়েছেন, তেমনি তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের উঠোনে পা রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার। ছোটগল্পকে গণমুখী ও গণমানুষের ভেতরে নেওয়ার একক কৃতিত্ব তাঁর। রবীন্দ্রনাথের আগে যে গদ্য লেখা হয়নি, তা নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে বঙ্কিমচন্দ্র পর্যন্ত বাংলা গল্পের চৌহদ্দীর বিস্তৃত ছিল না। এককথায় বলা যায়, অল্পদস্তুর ক্ষমতা অর্জন করেছিল বাংলা গল্প।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রা তিনজনই সংস্কৃতপ্রবণ বাংলা লিখতেন। বিশেষত বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা তো দুর্বোধ্য ছিল সাধারণ মানুষের কাছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এসে বাংলা সাহিত্যের, তথা বাংলা গল্পের রুদ্ধ দুয়ার একেবারে খুলে দিলেন। রবীন্দ্র-বিরোধিতা থাকলেও এ কথা সত্য যে, সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে বিশ্বকবির লেখনীর পরশ লাগেনি।
আমরা তাঁর ছোটগল্পে যে বাস্তবতা দেখতে পাই, সেটা রবীন্দ্র সাহিত্যের অন্যান্য ধারা থেকে আলাদা। বিশ্বসাহিত্যের যে কয়জন হাতেগোনা শ্রেষ্ঠ গল্পকার রয়েছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে আসন পেয়েছেন। তাঁর লেখার প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে যে বাস্তবতা দেখা যায়, তাতে মানুষ মনুষ্যত্ব, প্রকৃতি পরিবেশ, প্রবাহিত জীবন থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষের কথা বারবার প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে শিল্প সুষমার সৃষ্টি রসের ধারায়। সাহিত্যের জগৎটাকে বিশ্বকবি অবারিত সৃষ্টিতে এমনভাবে প্রস্ফুটিত করে গেছেন, যাতে প্রত্যূষে রবির উদয় আর গোধুলির সব রং মিশে নতুন সৃষ্টির বিজয় কেতন উড়িয়েছে, যার সবটাই বিশ্বকবির হাতের ছোঁয়ার পরশে ধন্য।
‘রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসে ও ছোটগল্পে সমগ্র বঙ্গদেশকে যেন নগরবঙ্গে ও পল্লীবঙ্গে ভাগ করিয়া লইয়াছেন। একথা আগেই বলিয়াছি। তাহার ছোটগল্পের ক্ষেত্র পল্লীবঙ্গকেও যেন আবার দুটি ভাগে ভাগ করা সম্ভব। পল্লীবঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে আছে মানুষ ও প্রকৃতি, জনপদ ও প্রাকৃতিক দৃশ্য; একদিকে গ্রাম ও ছোটখাট শহর আর একদিকে নদ-নদী, বিল-খাল,শস্যহীন ও শস্যময় প্রান্তর, আর সবচে বেশি করিয়া আছে রহস্যময়ী পদ্মা। মোটের উপর বলিলে অন্যায় হইবে না যে এই পর্বে লিখিত কাব্য-কবিতার রসের উৎস এই প্রকৃতি। আর ছোটগল্পগুলির রসের উৎস এইসব জনসপদ। কবিতায় প্রতিধ্বণি নদ-নদীর, ছোটগল্পে প্রতিচ্ছবি জনপদগুলির। এই স্থল ভাগ সত্য হইলেও একেবারে ওয়াটার-টাইট বা জল-অচল ভাগ নয়। এক ভাগের রেশ অপরভাগে আসিয়া পড়িয়াছে। তাই ছোটগল্পে পাইব প্রাকৃতিক স্পর্শ আর কবিতায় পাইব মানবিক স্পর্শ।রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন যে, তাহার সাহিত্যে যেন দুটি আকাঙ্ক্ষা আছে- সুখদুঃখ বিরহমিলন পূর্ণ মানব সমাজে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা, আবার নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যলোক উধাও হইয়া পড়িবার আকাঙ্ক্ষা। পূর্বোক্ত ভাগ যেন দুটি আকাঙ্ক্ষার আশ্রয়। ছোটগল্পগুলির মধ্যে পাই সুখদুঃখ বিরহমিলন পূর্ণ মানব সমাজে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা’ (রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প/প্রমথনাথ বিশী, পৃষ্ঠা ৯-১০)।
অন্যদিকে মার্কসীয় শ্রেণি চরিত্রের বিচারে যদি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পকে দেখি, তাহলে স্পষ্ট হয় যে, ‘প্রথম দিক, মধ্য দিক বা শেষ দিকের রচনা যাই হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে ভাববাদ বা আধ্যাত্মিকতার কোনো স্থান নাই। আছে মানুষ, সামাজিক মানুষ, সাধারণ গরীব মধ্যবিত্ত নরনারী। একেবারে দরিদ্র্য ও সাধারণ মানুষকে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের পাতায় তুলে ধরেছেন এবং সেটা ছোটগল্পে।’ (রবীন্দ্রনাথ, শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে/হায়দার আকবর খান রনো, পৃ-১৪৩)
এ কথার পর আমরা এটা সহজেই বুঝতে পারি যে, হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকার চাহিদা মেটাতে তিনি তাঁর ছোটগল্পগুলো রচনা করেছিলেন বলে যে প্রচলিত কথা রয়েছে, তা ঠিক ধোপে টিকে না। অর্থাৎ এ কথার মধ্যে রবীন্দ্র ছোটগল্পর সীমাবদ্ধ রইল না। এই গল্পগুলোর উচ্চ সাহিত্যমূল্যসম্পন্ন এবং রবীন্দ্র গল্পের ভেতরে আমরা যে বিষয়টি খুঁজে পাই তা হলো, রবীন্দ্রনাথ তার ছোটগল্পের মধ্যে প্রাকৃতিক স্পর্শ পেতেন, পেতেন সুখ-দুঃখ বিরহমিলন পূর্ণ মানব সমাজে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা। আবার ভাববাদের কোনো স্পর্শ এখানে নেই। তবে রবীন্দ্রনাথের গল্প মার্কসবাদী ধারার না হলেও তাঁর গল্পে এক ধরনের রিয়েলেস্টিক মেটেরিয়ালিজম ভর করে থাকে। রবীন্দ্রনাথের গল্পের বিষয় ও চরিত্রে নিম্নবর্গের দরিদ্র, সম্বলহীন মানুষের জীবন দেখা যায়। কিন্তু যে অর্থনৈতিক প্রাচীরে তাদের জীবনকে এ অবস্থায় রেখেছে তার চরিত্রগুলো ওই মরা সমাজ ভাঙতে উদ্যত হয় না। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নায়িকারা যেমন বিদ্রোহী সেদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, গল্পের প্রেক্ষাপটে বিপ্লবের প্লট থাকলেও কোথাও বিদ্রোহের বাণী নেই।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের সাধনার পর্বটি (১৮৯১-৯৫) সাল অবধি ধরা যায়। এ সময়কে তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল কাল হিসাবে অবিহিত করলেও বোধ করি অত্যুক্তি হবে না। তাঁর গল্পগুচ্ছ গল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে। গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্য গল্পগুলির অনেকগুলিই রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনের সবুজ পত্র পর্বে (১৯১৪-১৭; প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নামানুসারে) তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হলো কঙ্কাল, নিশীথে, মণিহারা, ক্ষুধিত পাষাণ, স্ত্রীর পত্র, নষ্টনীড়, কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, দেনাপাওনা, মুসলমানীর গল্প ইত্যাদি। শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ লিপিকা, সে ও তিনসঙ্গী গল্পগ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে গল্প রচনা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি বা আধুনিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতেন। কখনো তিনি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বৌদ্ধিক বিশ্লেষণকেই গল্পে বেশি প্রাধান্য দিতেন।
কুষ্টিয়া, শাহজাদপুর বা তার পদ্মা পর্বের গল্পগুলোতে দেখি—‘বাংলাদেশের একটি নির্জন প্রান্ত, তার নদীতীর, উন্মুক্ত আকাশ, বালুর চর, অবারিত মাঠ, ছায়া-সুনিবিড় গ্রাম, সহজ অনাড়ম্বর পল্লীজীবন, দুঃখপীড়িত অভাবে ক্লিষ্ট অথচ শান্ত সহিষ্ণু গ্রামবাসী, সবকিছুকে কবির চোখের সামনে মেলে ধরেছে, আর কবি বিমুগ্ধ বিস্ময়ে, পুলকিত শ্রদ্ধায় ও বিশ্বাসে তার অপরিসীম সৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করছেন। এমনি ভাবে তিনি গ্রামের সহজ সরল মানুষের সাথে তিনি একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। এর মাঝেই তার ভাব-কল্পনার মধ্যে আপনা আপনি গল্পগুলো রূপ পেতে আরম্ভ করল, তুচ্ছ ক্ষুদ্র ঘটনা ও ব্যাপারকে নিয়ে বিচিত্র সুখ-দুঃখ অন্তরের মধ্যে মুকুলিত হতে লাগল।এ সময় সাজাদপুরে একজন পোস্টমাস্টারের আগমন উপলক্ষে পোস্টমাস্টার গল্পটির সৃষ্টি হলো।’ (রবীন্দ্রনাথ ও ছোটগল্প- অমলেশ ত্রিপাঠী)
পোস্টমাস্টার গল্পে অনাথিনী রতন তার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে শাশ্বত নারী সত্তার যে পরিণতি তা অত্যন্ত প্রগাঢ় ভাবে দেখা দেয়। নারী হৃদয়ের যে কান্না তা পাঠকের হৃদয় অরণ্যে এক সূক্ষ্ম দাগ কেটে গেছে। রতন সেই পোস্টআপিস গৃহের চারিদিকে অশ্রুজল ভাসিয়া ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে। রতনের এই অশ্রুজলের পেছনে বাস্তবে কোন সামাজিক অথবা সাংসারিক ব্যাপার ছিল না। সমস্ত বেদনার উৎস কেন্দ্র হৃদয় রহস্যের গভীরে প্রোথিত। নব্য ইউরোপীয় সভ্যতা দীক্ষিত পোস্টমাস্টার সমাজ সংসার বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। পারেনি অনাথিনী রতনকে তার জীবনধারায় একাকার করে দিতে।
‘ইউরোপীয় সভ্যতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নগর পল্লীর ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে গেছে আমাদের দেশে। এ দুইয়ের মধ্যে কোন প্রকারের হৃদয় সেতুবন্ধন সম্ভব নয়।পল্লী হৃদয়ের সঙ্গে শহরের হৃদয়ের কোন সূত্রেই বাধা পড়ে না—পোস্টমাস্টার গল্পে সেকথা আরেকটু বেশি করে মনে হয়।’ (রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা, আনোয়ার পাশা)
তাঁর গল্পগুচ্ছের সর্বমোট ১১৯টি গল্পের প্রকাশভঙ্গিমা পর্যায়ের ব্যতিক্রমধর্মী। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ যে কথা কবিতায়, গানে প্রকাশ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং যে কথা তিনি সাধারণ, সাবলীল ভাষায় বলতে পারেননি গানের মাধ্যমে তাই-ই ব্যক্ত করেছেন গল্পে। তারপরও জীবনাচার, ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে না গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন ছোটগল্পের যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে তিনি নিজেই সারথি এবং নিজেই অর্জুন। কখনো কথক ভঙ্গিমায়, কখনোবা বৈঠকি ঢঙে আবার কখনোবা মারাত্মক পর্যায়ের গাম্ভীর্যের মাধ্যমে তার কাব্যভাষা পরিশীলিত রূপে রূপান্তরিত হয়েছে গদ্য ভাষায়। আবার তার গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি যে বাকময়তা এবং একটি ঘটনাকে সম্প্রসারিত করে কয়েকটি দীর্ঘ ঘটনার প্রকাশ আর যে চলমান ভঙ্গিমা সত্যিকার অর্থেই সেটি বাংলা সাহিত্যের এক নতুন দরোজা খুলে দিয়েছিল যার কারণে রবীন্দ্রনাথ গল্পের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে চরম সার্থকতায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ছোটগল্প রচনার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্পর্কেই করে গেছেন, সহজ এবং সাবলীল স্বীকারোক্তি, ‘আমি প্রথমে কেবল কবিতাই লিখতুম, গল্পে-টল্পে বড় হাত দিই নাই, মাঝে একদিন বাবা ডেকে বললেন, ‘তোমাকে জমিদারির বিষয়কর্ম দেখতে হবে।’ আমি তো অবাক; আমি কবি মানুষ, পদ্য-টদ্য লিখি, আমি এসবের কী বুঝি? কিন্তু বাবা বললেন, ‘তা হবে না, তোমাকে এ কাজ করতে হবে।’ কী করি? বাবার হুকুম, কাজেই বেরুতে হলো। এই জমিদারি দেখা উপলক্ষে নানা রকমের লোকের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয় এবং এ থেকেই আমার গল্প লেখারও শুরু হয়।’ (শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ/ জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপ্রিভাত, ভাদ্র/১৩১৬)
রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, দিনাতিপাত এবং সাধারণের জীবনদর্শনকে কাজে লাগিয়ে তুলে ধরা যাবে পুরো সমাজচিত্র এবং তার মাধ্যমেই সমৃদ্ধ হবে গোটা বাংলা সাহিত্য। যদিও পদ্মা বোটে, পাবনার শাহজাদপুর এবং নওগাঁর পতিসরে জমিদারি তদারকির সুবাদেই রবীন্দ্রনাথের গল্পে উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজের উঁচু স্তর থেকে পুরোপুরি নিচুস্তরের মানুষের কথা, আচার-ব্যবহার-সংস্কৃতি আর নির্বিকার শুদ্ধ জীবনাচার। রবীন্দ্রনাথের পুরো সাহিত্য জীবনকে বিশ্লেষণ করলে ছোটগল্পের সময়টুকু খুব বড় তা নয় বরং ব্যাপক বর্ণাঢ্য এবং সুগভীর দৃষ্টিভঙ্গিমার সার্থক উপমা। তার গল্পের অধিকাংশ ঘটনা এবং চরিত্র বাস্তব এবং কেবলমাত্র ভালোবাসার চাদরে মোড়ানো এসব চরিত্রের প্রকাশ।
বিষয়বস্তুর দিকে লক্ষ করলে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোকে প্রেম, সামাজিক জীবে সম্পর্ক বৈচিত্র্য, প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের নিগূঢ় অন্তরঙ্গ যোগ ও অতি প্রাকৃতের স্পর্শ এই কয়টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। সামাজিক সম্পর্কের বিচিত্র চিত্র রূপায়িত গল্পগুলোর মধ্যে দান-প্রতিদান, দেনা-পাওনা, ছুটি, হৈমন্তী, পুত্রযজ্ঞ, পোস্ট মাস্টার, কর্মফল, কাবুলিওয়ালা উল্লেখযোগ্য।
অপরদিকে প্রকৃতির সঙ্গে অতিপ্রাকৃত গল্পের যোগাযোগ সম্পর্কিত গল্পের মধ্যে গুপ্তধন, জীবিত ও মৃত, নিশীথে, ক্ষুধিত পাষাণ উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের গল্পের ভাষাবৈচিত্র্য এবং প্রকাশভঙ্গিমা সম্পূর্ণ আধুনিক এবং ব্যতিক্রম। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ছোটগল্প সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সমস্ত গল্প পর্যালোচনা করিয়া তাঁহার প্রসার ও বৈচিত্র্য চমৎকৃত না হইয়া থাকিতে পারি না। আমাদের পুরাতন ব্যবস্থা ও অতীত জীবনযাত্রার সমস্ত রসধারা অগস্ত্যের মতো তিনি এক নিঃশ্বাসে পান করিয়া নিঃশেষ করিয়াছেন বাংলার জীবন ও বহিঃপ্রকৃতি তাহাদের সৌন্দর্যের কণামাত্রও তাঁহার আশ্চর্য স্বচ্ছ অনুভূতির নিকট হইতে গোপন করিতে সমর্থ হয় নাই। অতীতের শেষ শষ্যগুচ্ছ ঘরে তুলিয়া তিনি ভবিষ্যতের ক্রমসঞ্চয়ীমান ভাব সম্পদের দিকে অঙ্গুলি সংকেত করিয়াছেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্পের অন্দরে-বাহিরে অবাক করা এক ভুবন তৈরি করে গেছেন, যা কেবল বাংলা সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেছে তাই-ই না সেই সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের অমিতাভ বিভারূপে বিরাজমান। কবিতা, গান, উপন্যাসসহ নাটকের যে দখল তার ছোটগল্প সেগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। সময় আর সভ্যতার প্রয়োজনে নয়, বরং রবীন্দ্রনাথ নিছক প্রকৃতি আর প্রেমের বাস্তবিক রূপ প্রকাশের তাগিদ থেকেই সৃষ্টি করেছেন তার প্রতিটি গল্প এবং যা পরবর্তীতে এক বিশাল মহীরূহ রূপে বিরাজমান আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে।’
রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলীর অনেক চিঠিই এ মন্তব্যের স্বপক্ষ সমর্থন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের প্রসঙ্গে ছিন্নপত্রাবলীর পত্রে লিখেছিলেন, ‘পুরোনো ইতিহাস ছিল তার হাড়গুলো বের করে; তার মাথার খুলিটা আছে, মুকুট নেই। তার উপরে খোলস মুখোশ পরিয়ে একটা পুরোপুরি মূর্তি মনের জাদুঘরে সাজিয়ে তুলতে পেরেছি তা বললে বেশি বলা হবে। ঢালচত্তির খাড়া করে একটা খসড়া মনের সামনে দাঁড় করিয়েছিলুম, সেটা আমারই খেয়ালেরই খেলনা।’ (পত্র-১৪৯; ছিন্নপত্রাবলী)
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ছোটগল্প নিয়ে বাংলাদেশে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। গল্পের আঙ্গিক, বিষয়বস্তু, সংলাপ, চরিত্রায়ণ, এই বিষয়গুলোতে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গল্পের যে ভাষা ছিল এবং ছোটগল্প সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা ছিল সেগুলো তাঁর পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প লেখকদের মধ্যে তেমন একটা দেখা যায়নি।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তিনটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পের ভেতরে কখনো প্রবেশ করেননি। যাদের গল্প, তাদের গল্পই তিনি লিখেছেন। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের কবিতার মত তাঁর ছোটগল্পেও প্রকৃতি একটা বিরাট জায়গা দখল করে আছে। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য যেটা, সেটা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ভাষা। রবীন্দ্রনাথ যখন ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন তখন তো বাংলা সাহিত্যের গদ্যের অবস্থা ছিল হাঁটি হাঁটি পা পা। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের দেড়শ বছর
রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে এ সময়ের গল্পকাররা (কিস্তি ২) প্রমা সঞ্চিতা অত্রি । বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ২৩ অক্টোবর ২০১১)
রবীন্দ্রনাথ সেই ছোটগল্পকে প্রাণ দিয়েছেন। তাঁর ছোটগল্প তাঁকে বিশ্বমানে আসন দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ও ছোটগল্প সমার্থক সাহিত্যধারায় রূপ নিয়েছে। ছোটগল্পের আজ যে নীরিক্ষা চলছে এসবকিছুর মূলেই রবীন্দ্রনাথ। দ্বিমত-বহুমতের মধ্য দিয়েও রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পের পুরোধা। ইতিহাস ও বাস্তবতার পরিক্রমা সে কথাই বলে। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ৮০ বছর বয়সে তাঁর মহাপ্রয়ান ঘটে। তাঁর জীবন ও কর্মের প্রতি জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।