গল্প
কেউ কখনো মরে না
[আর্নেস্ট হেমিংওয়ে : (১৮৯৯-১৯৬১ খ্রি.) মার্কিন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। সৈনিক হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত ছিলেন সাংবাদিক হিসেবে। অন্টারিওর টরন্টোতে ফ্রিল্যান্সার, স্টাফ রিপোর্টার ও বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন টরন্টো স্টার পত্রিকায়। তাঁর রচিত উপন্যাস : দ্য সান অলসো রাইজেস (১৯২৬), ফিয়েস্তা (১৯২৭), আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস (১৯২৯), ফর হোম দ্য বেল টোলস (১৯৪০), দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি (১৯৫২) ইত্যাদি। ফিকশনের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পান ১৯৫৩ সালে এবং পরবর্তী বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ‘নো বডি এভার ডাইস’ গল্পটি অনূদিত হলো তাঁর ‘দ্য কমপ্লিট শর্ট স্টোরিজ অব আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’ (১৯৮৭) বই থেকে।]
বাড়িটি তৈরি গোলাপি রঙের পলেস্তারা দিয়ে যা স্যাঁতসেঁতে হয়ে খসে পড়েছে আর বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাড়িটির বারান্দা থেকে রাস্তার শেষে তুমি দেখতে পাবে সমুদ্র, খুব নীল। ফুটপাত ঘেঁষে লরেল গাছগুলো এতটা উঁচু যে বারান্দার উপরের দিকটায় ছায়া পড়েছে আর ছায়ার কারণে জায়গাটা বেশ শীতল। বারান্দার এক কোণে কঞ্চি দিয়ে বানানো খাঁচায় একটি মকিংবার্ড। পাখিটি এখন গান গাইছে না, কিচিরমিচিরও করছে না, কারণ ২৮ বছরের এক তরুণ, হালকা-পাতলা গড়নের, কালো, যার চোখের নিচে নীলচে বৃত্ত আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, তার পরনের সোয়েটারটি এইমাত্র খুলে ছড়িয়ে রেখেছে খাঁচাটার উপর। সেই তরুণ এখন দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখ একটুখানি খোলা, শুনছে কিছু। হুড়কা লাগানো এবং তালা দেওয়া বাইরের দরজাটি কেউ খোলার চেষ্টা করছে।
যখন সে কান পেতে ছিল শুনতে পেল বারান্দার খুব কাছে লরেল গাছগুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ, রাস্তা ধরে আসা গাড়ির হর্ন এবং ফাঁকা ময়দানে খেলতে থাকা বাচ্চাদের কণ্ঠস্বর। তারপর সে আবারও বহিঃদরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ শুনতে পেল। চাবি খোলা ও হুড়কা টানার শব্দ পেল সে এবং তারপর আবার চারি ঘোরানোর শব্দ। একইসঙ্গে সে শুনতে পেল বেসবলে ব্যাট চালানোর শব্দ এবং ফাঁকা ময়দান থেকে আসা স্প্যানিশ ভাষায় কর্কশ চেঁচামেচি। সে ওখানে দাঁড়াল, তার ঠোঁট ভেজাল এবং কান পেতে শুনল যখন কেউ পেছনের দরজা খুলতে চেষ্টা করল।
তরুণ ছেলেটি, যার নাম এনরিক, তার জুতা খুলল এবং সাবধানে নিচে রেখে আলতো পায়ে এগিয়ে গেল বারান্দার টালি অব্দি যাতে সে পেছন দরজার দিকে নজর রাখতে পারে। সেখানে কেউ নেই। পা ঘসটে সে বাড়িটির সামনের দিকটায় গেল এবং নিজেকে আড়াল করে রাস্তার দিকে তাকাল।
লরেল গাছগুলোর নিচের ফুটপাত ধরে এক নিগ্রো হাঁটছিল যার পরনে ধূসর আলপাকা কোট এবং কালো ট্রাউজার আর মাথায় তৃণনির্মিত সরু প্রান্ত-অলা চ্যাপ্টা টুপি। এনরিক দেখল, ওখানে অন্য কেউ নেই। সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখল আর কান পেতে থাকল, তারপর সে তার সোয়েটারটা পাখির খাঁচার উপর থেকে নিয়ে পরে ফেলল।
সে খুব ঘামছিল যখন কান খাড়া করে শুনছিল আর এখন উত্তর-পুব দিকের ঠান্ডা বাতাস আর ছায়ায় শীত অনুভব করল। সোয়েটারের সঙ্গে একটা চামড়ার খাপ, ঘামের কারণে নুন-সাদা হয়ে গেছে আর পড়েছে গোল দাগ, এতে সে একটা ৪৫ ক্যালিবারের কোল্ট পিস্তল রাখে যার সার্বক্ষণিক চাপে তার বগলের নিচের দিকটায় ফোস্কা পড়ে গেছে। সে দেওয়ালের খুব কাছে একটা ক্যানভাসের দোলনায় গা এলিয়ে দিল। এখনো সে কান খাড়া করে শুনছে।
পাখিটা কিচিরমিচির করল এবং লাফিয়ে উঠল। এনরিক তাকাল সেদিকে। তারপর উঠে গিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিল। পাখিটি খোলা দরজার দিকে মাথা বাড়াল, এবং সরিয়ে নিল। তারপর সে তার ঠোঁটটি খাঁচার এক কোণের দিকে রেখে মাথাটা সামনের দিকে ঝাঁকাল।
‘উড়ে যাও, এটা কোনো চালাকি না,’ তরুণটি নরম কণ্ঠে বলল।
সে খাঁচার ভেতর হাত গলিয়ে দিল এবং পাখিটি পেছন দিকে সরে গেল, ডানা ঝাপটাল কঞ্চিগুলোর গায়ে।
‘বোকা পাখি,’ বলল তরুণ।
সে তার হাতটি খাঁচার বাইরে আনল, ‘আমি এটিকে খোলা রেখেই যাব।’
সে মুখ নিচের দিক করে দোলনাটিতে শুয়ে পড়ল, ভাঁজ করা দু’বাহুর উপরে তার থুতনি। তখনো সে শুনছিল। শুনতে পেল পাখিটি খাঁচা থেকে উড়ে গেল এবং তারপর শুনল লরেল গাছগুলোর কোনো একটিতে বসে পাখিটি গান গাইছে।
‘বাড়িটি যদি খালিই থাকবে তবে পাখিটিকে রেখে যাওয়াটা বোকামি,’ সে ভাবল। ‘এটা এমন এক বোকামি যা থাকে যাবতীয় সমস্যার গোড়ায়। আমিই যদি সে নির্বোধ লোকটি হই, তাহলে অন্যদের দোষ দিই কী করে?’
ফাঁকা ময়দানে এখনো ছেলেরা বেসবল খেলছে এবং এখন বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে। তরুণ ছেলেটি কাঁধ থেকে চামড়ার খাপটি খুলে বড় পিস্তলটি পায়ের কাছে রাখল। তারপর সে ঘুমাতে গেল।
সে যখন জেগে উঠল তখন অন্ধকার, আর লরেল গাছের পাতার ভেতর দিয়ে সড়কবাতির আলো গিয়ে পড়েছে আগন্তুকের উপর। সে উঠে দাঁড়িয়ে বাড়িটির সামনের দিকে গেল। নিজেকে দেওয়ালের আড়ালে ছায়ায় ঢেকে রাস্তাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। সরু প্রান্ত-অলা চ্যাপ্টা টুপি পরা লোকটা গাছতলা এক আগন্তুকের সামনে দাঁড়ানো। এনরিক তার কোট বা ট্রাউজারের রং দেখতে পেল না, তবে সে ছিল একজন নিগ্রো।
এনরিক শিগগির বারান্দার পেছন দিকে গেল কিন্তু সেখানে কোনো আলো ছিল না কেবল পরের দুটি বাড়ির পেছনের জানালা দিয়ে ঘাসের মাঠে পড়া আলোটুকু ছাড়া। পেছন দিকটায় যেকোনো সংখ্যক লোক থাকতে পারে। সে এটা জানে কারণ বিকালবেলার মতো করে আর সে কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না কারণ দ্বিতীয় বাড়িটায় একটা রেডিও বেজে চলেছে।
ক্রমশ উচ্চগ্রামে ওঠা সাইরেনের যান্ত্রিক শব্দ শোনা গেল হঠাৎ, আর তরুণ ছেলেটির করোটির ভেতর শিরশির করা তরঙ্গ বয়ে গেল। যেমন করে কেউ সহসা আরক্তিম হয়ে ওঠে, তেমনি হঠাৎ এলো সেটা। হুল ফোটানোর আঁচের মতো অনুভব করল সে, আর সেটা যেমন দ্রুত এলো তেমনি দ্রুত চলেও গেল। সাইরেনটা বাজছিল রেডিওতে; এটা ছিল একটা বিজ্ঞাপনের অংশ, এবং পরে ঘোষকের বক্তব্য শোনা গেল, ‘গাভিস টুথ-পেস্ট। যার বিকল্প নেই, যা না হলেই নয়, যা সবচে’ ভালো।’
অন্ধকারে হাসল এনরিক। এখন একজনের আসার সময়।
সাইরেনের পর রেকর্ড করা ঘোষণায় এক শিশুর কান্নার শব্দ এলো যে শিশুটি ঘোষকের কথা অনুযায়ী তৃপ্ত হতে পারে কেবল মাল্টা-মাল্টা পেলে। তারপর একটি হর্ন, এবং একজন গ্রাহক সবুজ গ্যাস চাইল। ‘আমার কাছে কোনো গল্প ছাড়বেন না, আমি সবুজ গ্যাস চাই। অনেক শস্তা, অল্প গ্যাসে বেশি মাইল যায়, সবচে’ ভালো।’
সব বিজ্ঞাপন এনরিকের মুখস্ত। যে সময়টাতে সে যুদ্ধক্ষেত্রে ছিল সেই পনের মাসে ওগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি; সম্প্রচার কেন্দ্রে তারা অবশ্যই একই রেকর্ড এখনো ব্যবহার করে যাচ্ছে; আর সাইরেনটা তাকে ধোঁকা দিয়েছে এবং তার করোটির ভেতর তীক্ষ্ণ আর ত্বরিত হুল ফুটিয়েছে যা বিপদাশঙ্কায় পড়া পাখির নিশ্চিত প্রতিক্রিয়ার মতো, যেমনটা কুকুর সুদৃঢ় করে কোয়েলের উষ্ণ গন্ধ নিতে গিয়ে।
করোটির ভেতর হুল ফোটানোর ব্যাপারটা শুরুতে ছিল না। এ থেকে আসা বিপদ ও ভয়ে এক সময় সে ক্ষুধা অনুভব করল। তার এমন দুর্বল লাগল যেমনটা তোমার জ¦রের সময় হয়; এবং সে বুঝল যে, তার নড়াচড়ার সামর্থ্যটুকুও নেই; যখন তুমি পায়ে ভর দিয়ে জোর করে সামনে এগোতে চাও এবং অনুভব করো যে, পা দুটি এমন নিথর যেন তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। এসবের কিছুই এখন নেই, আর সে কোনো অসুবিধা ছাড়াই করতে পারছে যা যা তার করা উচিত। করোটির ভেতরকার শিরশিরানিটাই কেবল ভয়ের সামর্থ্য হিসেবে থেকে যায়, যা দিয়ে সাহসী লোকেরা শুরু করে। তার ক্ষেত্রে এটা ছিল ভয় সম্পর্কিত তার প্রতিক্রিয়ার অবশেষ, যদিও তার ঘাম ঝরছিল, সে জানে, এটা তার মধ্যে সবসময় থাকবে, এবং এখন এটা কাজ করছে সতর্ক-সঙ্কেত হিসেবে, এর বেশি কিছুই না।
সে যখন উঠে গিয়ে বাইরে গাছের দিকে তাকাল যেখানে চ্যাপ্টা টুপি পরা লোকটা এখন বসে আছে ফুটপাতের ধারে প্রস্তরের উপর। একটা নুড়িপাথর এসে পড়ল টালি বারান্দায়। এনরিক দেওয়ালের কাছে ওটাকে খুঁজল, কিন্তু পেল না। সে দোলনার নিচে হাত চালাল কিন্তু ওখানেও নেই। সে যখন হাঁটু মুড়ে বসল, আরেকটা নুড়ি পাথর টালির মেঝেতে এসে পড়ল। সেটা লাফিয়ে এবং গড়িয়ে গিয়ে বাড়িটার পাশের রাস্তায় গিয়ে পড়ল। এনরিক ওটাকে কুড়িয়ে নিল। ওটা ছিল মসৃণ আর সাধারণ একটা নুড়ি। সে নুড়িটাকে পকেটে পুরে বাড়ির সিঁড়ির নিচে পেছন দরজার কাছে গেল।
এনরিক দরজার এক পাশে দাঁড়াল। খাপ থেকে কোল্ট পিস্তলটা বের করে ডান হাতে ধরল শক্ত করে।
‘বিজয়’ নরমভাবে সে বলল, অবজ্ঞাভরা মুখে, আর তারপর নগ্ন পায়ে সে আলগোছে দরজার অন্য পাশে সরে গেল।
‘তাদের জন্য যারা তা অর্জন করে,’ দরজার বাইরে থেকে বলল কেউ। ওটা ছিল এক নারীর কণ্ঠস্বর, যা পাসওয়ার্ডের বাকী অর্ধেকটা উচ্চারণ করল। কথাগুলো সে বলল দ্রুত এবং অস্থিরতার সঙ্গে।
এনরিক দরজার হুড়কা দুটো পেছনে টানল এবং বাঁ হাত দিয়ে খুলে দিল দরজাটা, তার ডান হাতে কোল্ট পিস্তল।
অন্ধকারে দাঁড়ানো একটি মেয়ে, হাতে একটা ঝুড়ি। মাথায় সে পরে আছে একটা রুমাল।
‘হ্যালো’, বলে এনরিক দরজা বন্ধ করে হুড়কা লাগাল। অন্ধকারে সে তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। তার কাছ থেকে সে ঝুড়িটা নিল এবং তার কাঁধ চাপড়ে দিল।
‘এনরিক’, সে বলল। এনরিক দেখতে পাচ্ছিল না তার মুখ কিংবা কতটা জ্বলজ্বল করছিল তার চোখ।
‘উপরতলায় এসো, বাড়ির সামনে কেউ নজরদারি করছে। সে কি তোমাকে দেখেছে?’
‘না’, সে বলল। ‘আমি ফাঁকা ময়দানের ভেতর দিয়ে এসেছি।’
‘আমি লোকটাকে দেখাচ্ছি তোমাকে, উপরে বারান্দায় চলো।’
তারা সিঁড়ি ধরে উপরে গেল, এনরিক বয়ে নিচ্ছিল ঝুড়িটা। সে ওটাকে বিছানার পাশে নিচে রাখল এবং বারান্দার শেষ প্রান্তে গিয়ে বাইরে তাকাল। সরু প্রান্ত-অলা তৃণনির্মিত চ্যাপ্টা টুপি পরা নিগ্রোটা চলে গেছে।
‘তো’, এনরিক শান্তস্বরে বলল।
‘তো কী?’ মেয়েটি তার হাত ধরে জিগ্যেস করল, তার দৃষ্টি বাইরে।
‘তো সে চলে গেছে। এটাতে কী খাবার আছে?’
‘আমি দুঃখিত, তুমি এখানে সারাদিন ধরে একা’, সে বলল। ‘এটা আমার বোকামি হয়েছে যে আমি এখানে আসার জন্য অন্ধকার হবার অপেক্ষা করছিলাম। আমি সারাদিন ধরেই এখানে আসতে চেয়েছি।’
‘এখানে থাকাটাই একটা বোকামি। দিনের আলো ফোটার আগে তারা একটা নৌকায় করে আমাকে এখানে এনেছে এবং চলে গেছে, খাবার-দাবার কিছুই রেখে যায়নি, একটা পাসওয়ার্ড ছাড়া, রেখে গেছে এমন একটা বাড়িতে যেটি নজরদারির মধ্যে আছে, আর তুমি তো একটা পাসওয়ার্ড খেতে পারো না। আরও নানা কারণে নজরদারির মধ্যে থাকা বাড়িতে আমাকে রাখাটা উচিত না। এটা খুবই কিউবাসুলভ। কিন্তু নিদেনপক্ষে পুরোনো দিনগুলোতে আমরা খেতাম। তুমি কেমন আছো, মারিয়া?’
অন্ধকারে সে চুমু খেল এনরিককে। দৃঢ়ভাবে, তার মুখে। সজোরে লেপ্টে রাখা ঠোঁটের পূর্ণতা আর চেপে থাকা তার দেহের কম্পন অনুভব করল সে। তারপর তার পেছনে ক্ষুদ্র স্থানটিতে ছুরিকাঘাতের সাদা যন্ত্রণাটা ফিরে এলো।
‘আইই! আস্তে, সোনা।’
‘কী হলো?’
‘পেছনে।’
‘পেছনে কী? কোনো ক্ষত?’
‘তোমার এটা দেখা উচিত,’ সে বলল।
‘এখন দেখব?’
‘পরে। খেয়ে এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে পড়া দরকার। এখানে তারা কী কী মজুত রেখেছে?’
‘অনেক কিছু। এপ্রিলের ব্যর্থতার পর যা যা ছেড়ে যাওয়া হয়েছিল। ভবিষ্যতের জন্য রাখা হয়েছে।’
‘বহুদূরের ভবিষ্যৎ,’ সে বলল। ‘তারা কি জানে এটা নজরদারির মধ্যে আছে?’
‘আমি নিশ্চিত এটা তারা জানে না।’
‘কী কী আছে?’
‘বাক্সের ভেতর আছে কিছু রাইফেল। কিছু বাক্স আছে গোলা-বারুদ ভরতি।’
‘আজ রাতের মধ্যেই সরানো উচিত।’ এনরিকের মুখ ভরতি খাবার। ‘এগুলো আবার দরকার পড়ার আগে আমাদেরকে বহু বছরের কাজ সারতে হবে।’
‘তুমি কি এই এসকাবেচে খেতে পছন্দ করো?’
‘এটা খুব ভালো; কাছে এসে বসো।’
‘এনরিক,’ সে বলল, তার সঙ্গে লেপ্টে বসে। একটা হাত সে তার ঊরুর উপর রাখল এবং অন্য হাতে তার কাঁধের পেছনে চাপড়ালো। ‘আমার এনরিক।’
‘আমাকে সাবধানে ধরো,’ খেতে খেতে বলল সে। ‘পিঠের অবস্থা খারাপ।’
‘যুদ্ধ থেকে ফিরে তুমি কি সুখী?’
‘এ বিষয়ে কিছু ভাবিনি,’ সে বলল।
‘এনরিক, চুচো কেমন আছে?’
‘মারা গেছে লেরিদায়।’
‘ফেলিপে?’
‘মারা গেছে, সেও লেরিদায়।’
‘এবং আতুরো?’
‘মারা গেছে তেরুয়েলে।’
‘আর ভিসেন্তে?’ সে ধরা গলায় জিগ্যেস করল, এখন তার ভাঁজ করা দুটি হাত এনরিকের ঊরুর উপর রাখা।
‘মারা গেছে। কালাদাসে রাস্তার উপর আক্রমণের সময়।’
‘ভিসেন্তে আমার ভাই।’ সে এখন স্থানু ও একা হয়ে বসল, তার হাত দুটি সে সরিয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে।
‘আমি জানি,’ বলল এনরিক। সে খেতে থাকল।
‘সে আমার একমাত্র ভাই।’
‘আমি ভেবেছি, তুমি জানতে,’ বলল এনরিক।
‘আমি জানি না, অথচ সে আমার ভাই।’
‘আমি দুঃখিত, মারিয়া। আমি তোমাকে অন্যভাবে বলতে পারতাম।’
‘এবং সে মৃত? তুমি জানো যে সে মৃত? এটা কি কেবল একটি প্রতিবেদন নয়?’
‘শোনো, রোহেজো, বাসিলিও, এস্তেবান, ফেল আর আমি বেঁচে আছি। অন্য সবাই মারা গেছে।’
‘সবাই?’
‘সবাই,’ বলল এনরিক।
‘এ আমি নিতে পারছি না,’ বলল মারিয়া। ‘প্লিজ, এ আমি নিতে পারছি না।’
‘আলোচনা করে কোনো লাভ নেই। তারা মারা গেছে।’
‘কিন্তু কেবল এটা তো না যে, ভিসেন্তে ছিল আমার ভাই, আমি আমার ভাইকে ছাড়তে পারি। কিন্তু সে ছিল আমাদের দলের কুসুম।’
‘হ্যাঁ। দলের কুসুম।’
‘এর কোনো মূল্য নেই। এটি আমাদের শ্রেষ্ঠতমকে ধ্বংস করেছে।’
‘হ্যাঁ, এর মূল্য আছে।’
সে এখন কাঁদছে এবং এনরিক খেয়ে যাচ্ছে। ‘কেঁদো না,’ সে বলল। আমাদেরকে যা করতে হবে তা হলো, ভাবতে হবে কিভাবে আমরা কাজের ভেতর দিয়ে তাদের জায়গা নিতে পারি।’
‘কিন্তু সে আমার ভাই। তুমি কি বুঝতে পারছো না? আমার ভাই।’
‘আমরা সবাই ভাই। কেউ কেউ মারা গেছে আর অন্যরা বেঁচে আছে এখনো। তারা আমাদেরকে এখন বাড়ি পাঠিয়েছে, তাই পেছনে রয়ে যাবে কেউ কেউ। নয়তো কেউই থাকবে না। এখন আমরা অবশ্যই কাজে নেমে পড়ব।’
‘কিন্তু কেন তারা সবাই মারা গেল?’
‘আমরা একটা আক্রমণ বিভাগে ছিলাম। তোমাকে হয় মরতে হবে, নয়তো আহত হতে হবে। আমরা অন্যরা আহত হয়েছি।’
‘ভিসেন্তে কী করে মারা গেল?’
‘সে একটা রাস্তা পার হচ্ছিল যখন ডানদিকের এক খামারবাড়ি থেকে মেশিনগানের গুলি এসে লাগে। ওই বাড়িটা থেকে রাস্তা ছিল গুলি নিক্ষেপের দূরত্বের ভেতর।’
‘তুমি কি সেখানে ছিলে?’
‘হ্যাঁ, প্রথম কোম্পানিটা ছিল আমার। আমরা ছিলাম তার ডানে। ওই বাড়িটাতে আমরা উঠেছিলাম কিন্তু এতে কিছুটা সময় লেগে যায়। ওখানে তাদের ছিল তিনটি মেশিনগান। দুটি ওই বাড়ির ভেতর ছিল আর একটি ছিল আস্তাবলে। এগোনোটা ছিল কঠিন। শেষ গোলাটা ছোঁড়ার আগেই একটা ট্যাঙ্ক থেকে জানালায় গোলা ছুঁড়ে ফিরতে হয়েছিল আমাদের। আটজনকে হারাতে হয় আমাকে। এটা অনেক বেশি।’
‘কোথায় ঘটেছিল এটা?’
‘সেলাদাসে।’
‘এর কথা আমি কখনো শুনিনি।’
‘না,’ বলল এনরিক। ‘যে অপারেশন সফল হয় না সেটার কথা কারো কাছে পৌঁছাবে না। ওখানেই ভিসেন্তে আর ইগনাসিও নিহত হয়েছিল।’
‘আর তুমি বলছ এসব ঘটনা ন্যায়সংগত? এমন সব মানুষগুলো বিদেশের মাটিতে ব্যর্থ হয়ে মারা পড়বে?’
‘যেখানে মানুষ হিস্পানিতে কথা বলে সেখানে বিদেশের মাটি বলে কিছু নেই, মারিয়া। কোথায় তুমি মারা গেলে সেটা বড় কথা নয়, যদি তুমি স্বাধীনতার জন্য মরো। যাইহোক, যা করতে হবে তা হলো বেঁচে থাকা, মারা যাওয়া যাবে না।’
‘কিন্তু যারা মারা গেছে তাদের কথা ভাবো— এখান থেকে দূরে— এবং ব্যর্থতায়।’
‘তারা নিহত হতে যায়নি। গেছিল যুদ্ধ করতে। মারা যাওয়াটা একটা দুর্ঘটনা।’
‘কিন্তু ব্যর্থতাগুলো। আমার ভাই মারা গেছে ব্যর্থতায়। চুচো মারা গেছে ব্যর্থতায়। ইগনাসিও মারা গেছে ব্যর্থতায়।’
‘তারা কেবল একটি অংশ। এমন কিছু আমাদেরকে করতে হয়েছিল যা ছিল অসম্ভব। অসম্ভব অনেক কিছুই আমরা করেছি। কিন্তু কখনো কখনো তোমার খুব কাছে থাকলেও তারা আক্রমণ করবে না। কোনো কোনো সময় পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। কখনো অপর্যাপ্ত শক্তি নিয়েও আক্রমণ করতে হয়েছে আদিষ্ট হয়ে— যেমনটা হয়েছে সেলাদাসে। এসবই ছিল ব্যর্থতার পেছনে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে এগুলো ব্যর্থতা নয়।’
মারিয়া কিছু বলল না এবং এনরিক খাওয়া শেষ করল।
এখন গাছগুলোর ভেতর বইছে অনাবিল বাতাস আর বারান্দায় ঠান্ডা পড়ে গেছে। সে পাত্রগুলো ঝুড়ির ভেতর রাখল এবং মুখ মুছল গামছা দিয়ে। সে তার হাত মুছল সাবধানে এবং তারপর বাহুতে জড়ালো মেয়েটিকে। সে কাঁদছিল।
‘কেঁদো না, মারিয়া,’ সে বলল। যা ঘটে গেছে ঘটে গেছে। আমাদের কী করতে হবে সেটাই ভাবতে হবে এখন। অনেক কিছুই করতে হবে আমাদের।’
মারিয়া কিছুই বলল না এবং সড়কবাতি থেকে এসে পড়া আলোয় সে দেখতে পাচ্ছিল সোজা সামনে তাকানো তার মুখ।
‘আমাদেরকে অবশ্যই রোমান্টিসিজম দূর করতে হবে। এ জায়গাটা রোমান্টিসিজমের একটা উদাহরণ। আমাদেরকে সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে যাতে আমরা আবারও বৈপ্লবিক এডভেঞ্চারবাদের খপ্পরে পড়ে না যাই।’
মেয়েটি এখনো কিছুই বলল না। এনরিক তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল যে মুখটিকে সেসব মাস ধরে কেবলি ভেবে গেছে যখন কাজ ছাড়া আর যেকোনো কিছুই ভাবতে পারতো সে।
‘তুমি কথা বলো যেন একটা বই,’ সে বলল। ‘একজন মানুষ না যেন।’
‘আমি দুঃখিত,’ বলল এনরিক। ‘যা আমি শিখেছি এটা কেবল তাই। এ এমন কিছু, আমি জানি তা আমাকে করতেই হবে। আমার কাছে এটা যে-কোনো কিছুর চেয়ে বেশি বাস্তব।’
‘আমার কাছে বাস্তব শুধু ওই মৃতেরা।’
‘আমরা তাদেরকে মর্যাদা দিই। কিন্তু তারা গুরুত্বপূর্ণ নয়।’
‘তুমি আবারও বইয়ের মতো করে বলছ,’ সে ক্ষুব্ধ হয়ে বলল। ‘তোমার হৃদয় একটা বই।’
‘আমি দুঃখিত, মারিয়া। আমি ভেবেছি তুমি বুঝবে।’
‘আমি বুঝি শুধু ওই মৃতদের,’ সে বলল।
এনরিক জানে এটা সত্য নয় কারণ তাদেরকে সে মরতে দেখেনি কেননা বৃষ্টির ভেতর সে ছিল হারামার জলপাই জঙ্গলে, কিহোরনার গুঁড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলোর উত্তাপের ভেতর, এবং তেরুয়েলে তুষারের ভেতর। কিন্তু সে জানে বেঁচে থাকার কারণে মারিয়া তাকে তিরস্কার করছে যখন ভিসেন্তে মৃত, এবং আকস্মিকভাবে— তার ছোট কিন্তু নিঃশর্ত মানবীয় অঙ্গ যা রয়ে গেছে এবং তা যে আছে সে তা অনুভব করতে পারে না— তাতে সে গভীর যন্ত্রণা অনুভব করল।
‘একটা পাখি ছিল,’ বলল এনরিক। ‘খাঁচার ভেতর একটা মকিংবার্ড।”
‘হ্যাঁ।’
‘আমি ওটাকে ছেড়ে দিয়েছি।’
‘তুমি কি সহৃদয় নও?’ বলল সে অবজ্ঞার সঙ্গে। ‘সব সৈনিকই কি ভাবপ্রবণ?’
‘আমি একজন ভালো সৈনিক।’
‘আমি তা বিশ্বাস করি। তোমার কথাবার্তা তেমনি। কেমন সৈনিক ছিল আমার ভাই?’
‘খুব ভালো। আমার চেয়ে উৎফুল্ল। আমি উৎফুল্ল নই। এটা আমার অপূর্ণতা।’
‘তবে তুমি আত্মসমালোচনার চর্চা করো এবং কথা বলো বইয়ের মতো।’
‘খুব ভালো হতো যদি আমি কিছুটা উৎফুল্ল হতাম,’ সে বলল। ‘এটা আমি কখনো শিখিনি।’
‘উৎফুল্লরা সবাই মারা গেছে।’
‘না,’ সে বলল। ‘বাসিলিও উৎফুল্ল।’
‘তাহলে সে মারা যাবে,’ সে বলল।
‘মারিয়া? এভাবে বলো না। তুমি পরাজিতের মতো কথা বলছো।’
‘তুমি কথা বলো একটা বইয়ের মতো,’ মারিয়া বলল তাকে। ‘প্লিজ, আমাকে ছুঁয়ো না। তোমার হৃদয় শুকিয়ে গেছে এবং আমি তোমাকে ঘৃণা করি।’
এখন তার যন্ত্রণা হচ্ছে আবার। সে জানে তার হৃদয় শুকিয়ে গেছে এবং এই ব্যথার চেয়ে বেশি আঘাত কোনো কিছুই তাকে দেবে না কখনো। বিছানায় বসে সামনের দিকে ঝুঁকল সে।
‘আমার সোয়েটারটা খোল,’ সে বলল।
‘আমি চাই না।’
‘এনরিক পেছন দিকটা ওঠাল এবং সামনে ঝুঁকল। ‘মারিয়া, ওখানে দেখ,’ বলল সে।
‘আমি দেখতে পারব না,’ সে বলল। ‘আমি দেখতে চাই না।’
‘পিঠের নিচের দিকে হাত রাখো।’
এনরিক তার আঙুলের স্পর্শ অনুভব করল সেই বড় গর্তে যার ভেতর একটা আস্ত বেসবল ঢুকিয়ে দেওয়া যেতে পারে, সেই কিম্ভূত ক্ষতচিহ্ন যা সৃষ্টি হয়েছিল যখন শল্যচিকিৎসক তার রাবারের দস্তানা পরা হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল পরিষ্কার করতে গিয়ে, যা তার পিঠের একপাশের ছোট গর্ত থেকে গিয়েছিল অন্য পাশ পর্যন্ত। তাতে সে তার স্পর্শ অনুভব করল আর দ্রুত কুঁচকে গেল নিজের ভেতর। তারপর মারিয়া শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল আর চুমু খেতে লাগল। তার ঠোঁট দুটি ছিল যন্ত্রণার সাদা সমুদ্রে এক আকস্মিক দ্বীপ যাতে আছড়ে পড়ল উজ্জ্বল, অসহ্য, উত্থিত আর আচ্ছন্ন করা তরঙ্গ যা তাকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দিল। ঠোঁট দুটি ওখানে, এখনো ওখানে; তারপর অভিভূত সে, যন্ত্রণাটা নেই, বসে আছে একা, ঘর্মাক্ত এবং মারিয়া কাঁদছে আর বলছে, ‘ওহ এনরিক। আমাকের ক্ষমা করো। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো।’
‘সব ঠিক আছে,’ বলল এনরিক। ‘ক্ষমা করার কিছু নেই। তবে এটা কোনো বই থেকে আসেনি।’
‘কিন্তু সারাক্ষণ কি ব্যথা হয়?’
‘কেবল যখন স্পর্শ বা ঝাঁকুনি লাগে।’
‘আর মেরুদণ্ড?’
‘একটুখানি স্পর্শ লেগেছিল। কিডনিতেও, তবে ওগুলো ঠিকঠাক আছে। শেলখণ্ডটা একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছিল। নিচের দিকে আরও ক্ষত আছে, দুই পায়েও।’
‘এনরিক, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো।’
‘ক্ষমা করার কিছু নেই। কিন্তু এটা মোটেও চমৎকার ব্যাপার না যে, আমি যৌনতায় যেতে পারি না এবং আমি উৎফুল্ল না।’
‘এটা ভালো হয়ে গেলে করতে পারব আমরা।’
‘হ্যাঁ।’
‘এবং এটা ভালো হয়ে যাবে।’
‘হ্যাঁ।’
‘এবং আমি তোমার যত্ন নেব।’
‘না। আমি তোমার যত্ন নেব। আমি এটা নিয়ে মোটেও ভাবছি না। শুধু স্পর্শ লাগলে বা ঝাঁকুনি খেলে ব্যথা হয়। আমরা অবশ্যই এখন কাজ করব। আমাদেরকে অবশ্যই এ জায়গাটা ছেড়ে যেতে হবে এখন। এখানে যা কিছু আছে, আজ রাতের মধ্যেই সরাতে হবে। এগুলো সংরক্ষণ করতে হবে একটা নতুন আর নজরদারী মুক্ত স্থানে এবং এমন একটা স্থানে যেখানে ওগুলোর ক্ষতি হবে না। ওসব দরকারে লাগার আগে অনেকটা সময় আমাদের হাতে। ওই পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে অনেক কাজ করে যেতে হবে আমাদের। অবশ্যই অনেককে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। ততদিনে এসব কার্তুজ হয়তো আর কাজে আসবে না। এ জলবায়ু কার্তুজগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। আর এখন আমাদের যেতে হবে। আমি একটা বোকা যে এতটা সময় ধরে এখানে আছি আর যে বোকা আমাকে এখানে রেখে গেছে, তাকে জবাব দিতে হবে কমিটির কাছে।’
‘তোমাকে আজ রাতে ওখানে নিয়ে যাবার কথা আমার। তারা ভেবেছে এই বাড়িটা আজকে তোমার থাকার জন্য নিরাপদ।’
‘এই বাড়িটা একটা বোকামি।’
‘আমরা যাব এখন।’
‘আগেই আমাদের যাওয়া উচিত ছিল।’
‘চুমু দাও, এনরিক।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু খুব সতর্কতার সঙ্গে,’ সে বলল।
তারপর, অন্ধকার বিছানায়, সতর্ক রেখে নিজেকে, বন্ধ দুচোখ, তাদের ঠোঁটগুলি লেপ্টে আছে পরস্পরের ঠোঁটে, সেখানে যন্ত্রণামুক্ত আনন্দ, সহসা সেখানে যন্ত্রণাহীন ঘরে ফিরে আসা, বেঁচে ফিরে আসা এবং যন্ত্রণা ছাড়া, ভালোবাসা পাবার আয়েশ এবং কোনো যন্ত্রণা তখনো নেই; কাজেই ভালোবাসায় আছে এক অসারতা, এখন আর অসার নয়, এবং দুটি করে ঠোঁট অন্ধকারে, পরস্পর লেপ্টে আছে যেন আনন্দ ও সহৃদয়তার সঙ্গে, তামস ও উষ্ণতার সঙ্গে ঘরে ফিরেছে এখন এবং অন্ধকারে যন্ত্রণাহীন, সবকিছু ছিন্ন করে হঠাৎ সাইরেনের শব্দ শোনা গেল, যেন জগতের সমস্ত যন্ত্রণা জাগিয়ে দিতে। এটা সত্যিকার সাইরেন, রেডিওতে বাজানো নয়। সাইরেন একটা নয়, দুটো। রাস্তার দুদিক থেকেই আসছিল আওয়াজ।
সে মাথা ঘোরাল এবং তারপর উঠে দাঁড়াল। ভাবল তার ঘরে ফেরা খুব দীর্ঘ হলো না।
‘দরজার বাইরে যাও, ফাঁকা ময়দানটা ধরে,’ সে বলল। ‘যাও। এখান থেকে আমি গুলি করব এবং ওদের মনোযোগ সরিয়ে দেব।’
‘না, তুমি যাও,’ বলল মারিয়া। ‘প্লিজ, আমি এখানে থাকব এবং গুলি করব আর তারা ভাববে তুমি ভেতরেই আছো।’
‘কথা শোনো,’ সে বলল। ‘আমরা দুজনেই যাব। এখানে আত্মরক্ষার অবস্থা নেই। এ জিনিসটা অচল। এখান থেকে যাওয়াটাই ভালো।’
‘আমি থাকতে চাই,’ সে বলল। ‘আমি তোমাকে রক্ষা করতে চাই।’
মারিয়া তার বগলের নিচে রাখা হোলস্টার থেকে পিস্তলটা নেবার জন্য এগোল এবং এনরিক তার গালে চড় মারল। ‘কথা শোনো, একটা নির্বোধ মেয়ে হয়ো না। কথা শোনো।’
তারা এখন সিঁড়ি ধরে নিচে নামছে এবং সে মারিয়াকে পেছনে তার খুব কাছে অনুভব করল। সে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলল এবং একসঙ্গে দরজার বাইরে পা দিল আর বিল্ডিং থেকে বেরুল। দরজাটা টেনে তালা বন্ধ করল এনরিক।
‘দৌড়াও, মারিয়া,’ সে বলল। ‘ওই দিকে মাঠটা ধরে যাও।’
‘আমি তোমার সঙ্গে যেতে চাই।’
সে তৎক্ষণাৎ আরেকটা চড় মারল। ‘দৌড়াও। তারপর ঘাসগুলোর ভেতর ডুব দাও আর হামাগুড়ি দিয়ে এগোও। আমাকে ক্ষমা করো, মারিয়া। কিন্তু যাও। আমি অন্য পথে যাচ্ছি। যাও,’ সে বলল। ‘দিব্যি দিচ্ছি, যাও।’
ঘাসগুলোর ভেতর তারা একই সঙ্গে যাওয়া শুরু করল। বিশ কদম দৌড়াল এনরিক এবং তারপর যখন পুলিশের গাড়িগুলো বাড়িটার সামনে থামল, সাইরেনের শব্দ কমে আসতে থাকল, সে সটান হয়ে পড়ে গিয়ে হামাগুড়ি দিতে শুরু করল।
ঘাসের রেণুতে নোংরা হয়ে গেল তার মুখ এবং যখন সে পাক খেয়ে খেয়ে পথ করে এগোচ্ছিল একাগ্রভাবে, তার হাত ও হাঁটুতে কাঁকর বিঁধে যাচ্ছিল ধারালোভাবে এবং সারাক্ষণ। সে শুনতে পেল তারা বাড়িটার দিকে এগোচ্ছে। ঘিরে ফেলেছে তারা বাড়িটাকে।
সে হামাগুড়ি দিয়ে দৃঢ়ভাবে এগোল, যন্ত্রণাটাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে। জোর করে ভাবতে চেষ্টা করল কিছু।
‘কিন্তু সাইরেনগুলো কেন?’ সে ভাবল। ‘পেছন দিকে তৃতীয় কোনো গাড়ি নেই কেন? কেন এই মাঠে কোনো স্পটলাইট বা সার্চলাইট নেই?’ সে ভাবল। ‘কিউবানরা কি এতটা নির্বোধ আর নাটুকে হতে পারে? তারা অবশ্যই ভেবেছে বাড়িটাতে কেউ নেই। তারা নিশ্চয় সরঞ্জামগুলো দখল করতে এসেছে। কিন্তু তাহলে সাইরেনগুলো কেন?’
পেছনে সে শুনতে পেল, তারা দরজা ভাঙছে। তারা সবাই ঘিরে রেখেছে বাড়িটাকে। বাড়িটার খুব কাছে সে হুইশেলের সঙ্গে দুটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনল। সে দৃঢ়ভাবে মুচড়ে মুচড়ে এগোল।
‘বোকার দল,’ সে ভাবল। ‘কিন্তু তারা এখুনি ঝুড়ি আর পাত্রগুলো দেখতে পাবে। কী লোকজন! বাড়ি রেইড দেবার কি ছিরি!’
সে এখন ময়দানটার প্রায় প্রান্তে এসে পড়েছে এবং সে জানে, সে উঠে পড়বে এবং রাস্তা বরাবর সজোরে দৌড়াবে দূরের বাড়িগুলির দিকে। যাতে কম ব্যথা লাগে এমনভাবে হামাগুড়ি দেবার কৌশল সে পেয়ে গেছে। যেকোনো চলনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারত সে। বিশ্রী পরিবর্তনটাই ঘা দিচ্ছে, এবং সে পায়ে ভর দিয়ে দৌড়াতে ভয় পেল।
ঘাসের ভেতর সে এক হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠল, যন্ত্রণার ধাক্কাটা গ্রহণ করল, সেটাকে সামলে নিল, এবং তারপর সেটাকে বয়ে নিল সামনে যাতে সে উঠে দাঁড়ানোর জন্য অন্য পা’টা হাঁটুর পাশে নিয়ে আসতে পারে।
পরবর্তী ময়দানটার পেছনে রাস্তার আড়াআড়ি থাকা বাড়িটার দিকে দৌড়াতে শুরু করল এনরিক, তখন সার্চলাইটটি চালু হয়ে তাকে ধরে ফেলল, এমনভাবে যাতে সে পুরোপুরি ঢুকে পড়ে আলোর ভেতর। সে তাকিয়ে আছে সেদিকে, আঁধারের দিকে, প্রতিটি পাশেই যার ধারালো রেখা।
সার্চলাইটের আলোটা এসেছে পুলিশের গাড়ি থেকে যেটি এসেছিল নিঃশব্দে, দাঁড়িয়ে ছিল ময়দানটির পেছনের এক কোণে।
যখন আলোকরশ্মির ভেতর হালকা-পাতলা, কৃশ এবং স্পষ্ট দৃশ্যমান এনরিক উঠে দাঁড়াল এবং বগলের নিচে থাকা হোলস্টার থেকে বড় পিস্তলটা টানতে গেল, তখনই অন্ধকারে থাকা গাড়িটা থেকে সাবমেশিনগানটা গুলিবর্ষণ শুরু করল তার উপর।
অনুভবটা ছিল বুক বরাবর গদার আঘাতের মতো এবং সে সেটা অনুভব করল কেবল প্রথমবার। আঘাতের অন্য যে শব্দগুলো এলো সেগুলো ছিল প্রতিধ্বনি।
সে এগোতে থাকল ঘাসগুলির ভেতর মুখ গুঁজে এবং যখন সে পড়ে গেল কিংবা হয়তো সেটা ছিল সার্চলাইট জ¦লে ওঠা এবং প্রথম বুলেটটা লাগার মাঝামাঝি কখনো, সে একটা কথাই ভাবতে পারল, ‘তারা অতোটা বোকা নয়। তাদের পক্ষে হয়তো কোনোকিছু করা সম্ভব।’
তার পক্ষে যদি অন্য একটা কিছু চিন্তা করার সময় থাকতো তাহলে সে আশা করতো যে, ময়দানটার অন্য কোণে কোনো গাড়ি নেই। কিন্তু অন্য কোণে একটা গাড়ি আছে এবং ওটার সার্চলাইট ঘুরছে মাঠের উপর দিয়ে। ওটার প্রশস্ত আলোকরশ্মি খেলে যাচ্ছে ঘাসগুলোর উপর, যেখানে মেয়েটি লুকিয়ে আছে। অন্ধকার গাড়িটাতে আছে মেশিনগানওয়ালারা, তাক করে রাখা বন্দুক অনুসরণ করছে আলোকরশ্মির তরঙ্গকে যা ঘুরে চলেছে থম্পসন মেশিনগানের মুখের সুরেলা আর দক্ষ কদর্যতা নিয়ে।
যে অন্ধকার গাড়িটা থেকে সার্চলাইটের আলো ছড়াচ্ছিল সেটার পেছনে এক নিগ্রো দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে সরু প্রান্ত-অলা তৃণনির্মিত চ্যাপ্টা টুপি এবং আলকাপা কোট। তার শার্টের নিচে সে পরেছে জাদুটোনার নীল পুঁতির মালা। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে লাইটগুলোর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করছে।
ঘাসের মাঠের উপর সার্চলাইটের আলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল যেখানে ভূমিতে সটান হয়ে শুয়ে ছিল মেয়েটি, মাটিতে লেপ্টে আছে তার গাল। যখন গোলা ফুটল তখন থেকে সে একটুও নড়েনি। ভূমিতে সে অনুভব করছিল তার হৃদস্পন্দন।
‘তুমি কি মেয়েটিকে দেখেছ?’ গাড়ির ভেতর থেকে একটা লোক জিগ্যেস করল।
‘ঘাসের ভেতর দিয়ে ওদেরকে তাড়িয়ে অন্য পাশে নিয়ে যাও,’ গাড়ির সামনের আসনে বসা লেফটেন্যান্ট বললেন। ‘হ্যালো,’ তিনি গাছতলা দাঁড়ানো নিগ্রোটাকে ডাকলেন। ‘বাড়িটাতে যাও আর ওদেরকে বলো যৌথভাবে ওদেরকে তাড়া করে আনতে। ওখানে কি কেবল দুইজনই ছিল?’
‘দুজন মাত্র,’ শান্ত স্বরে নিগ্রোটি বলল। ‘অন্যজনকে আমরা পেয়েছি।’
‘যাও।’
‘জ্বি স্যার,’ নিগ্রোটি বলল।
তৃণনির্মিত টুপিটি দুহাতে ধরে সে মাঠের প্রান্ত ঘেঁষে দৌড়াল বাড়িটির দিকে। বাড়িটির সব জানালা থেকে এখন আলো ছড়াচ্ছে।
মাঠের ভেতর মেয়েটি শুয়ে আছে, তার দুটি হাত আড়আড়িভাবে আঁকড়ে আছে মাথার উপরের দিকটা। ‘আমাকে সাহায্য করো যেন এটা সহ্য করতে পারি।’ ঘাসগুলির ভেতর সে বলতে থাকল, কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়, কারণ ওখানে কেউই ছিল না। তারপর, হঠাৎ, নিজে থেকে সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল, ‘আমাকে সাহায্য করো, ভিসেন্তে। আমাকে সাহায্য করো, ফেলিপে। আমাকে সাহায্য করো, কুচো। আমাকে সাহায্য করো, এনরিক। সাহায্য করো আমাকে।’
কখনো সে প্রার্থনা করে থাকবে, কিন্তু সেটা সে হারিয়ে ফেলেছে এবং এখন তার দরকার কিছু একটা।
‘যদি তারা আমাকে নিয়ে যায়, সাহায্য করো আমি যেন কথা না বলি,’ সে বলল, ঘাসের ভেতর মুখ গুঁজে। ‘কথা বলা থেকে আমাকে রক্ষা করো, এনরিক। কখনো যেন আমি কথা না বলি, ভিসেন্তে।’
পেছনে সে শুনতে পেল, ঘাসের ভেতর দিয়ে তারা ছুটছে যেন খরগোশ ধরার দল। অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে তারা এবং দাঙ্গাবাজদের মতো এগোচ্ছে, ঘাসের ভেতর বৈদ্যুতিক টর্চের আলো ফেলে ফেলে।
‘ও এনরিক,’ সে বলল। ‘আমাকে সাহায্য করো।’
সে তার হাত দুটো মাথা থেকে নামিয়ে মুছল দুপাশে। ‘এটাই ভালো হবে,’ সে ভাবল। ‘যদি আমি দৌড়াই, তারা গুলি করবে। এটা সহজতর হবে।’
ধীরে ধীরে সে উঠে পড়ল এবং গাড়িটার দিকে দৌড়াতে শুরু করল। সার্চলাইটের সমস্তটা আলো তার উপর, এবং সে দৌড়াল ওই আলোর দিকে, ওটার সাদা আচ্ছন্ন করা চোখের দিকে তাকিয়ে। সে ভাবল, যা করার তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
পেছনে তারা চিৎকার করছিল। কিন্তু কোনো গুলি ফুটল না। কেউ তাকে সজোরে জাপটে ধরল এবং সে পড়ে গেল। লোকটি যখন তাকে ধরল সে তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনল।
অন্য একজন তার বাহুর নিচে ধরে টেনে তুলল তাকে। দুই বাহু ধরে তারা তাকে গাড়িটার দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল। তাদের কেউ তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করল না, কিন্তু তারা তাকে দৃঢ়ভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল গাড়িটার দিকে।
‘না,’ সে বলল। ‘না। না।’
‘এ হলো ভিসেন্তে ইরতুবের বোন,’ বললেন লেফটেন্যান্ট। ‘সে আমাদের কাজে আসবে।’
‘আগেও তাকে জেরা করা হয়েছে,’ আরেকজন বলল।
‘তত গুরুত্ব দিয়ে করা হয়নি কখনোই।’
‘না,’ বলল মারিয়া। ‘না। না।’ সে জোরে চিৎকার করল, ‘আমাকে সাহায্য করো, ভিসেন্তে। আমাকে সাহায্য করো, সাহায্য করো, এনরিক!’
‘তারা মৃত,’ বলল কেউ একজন। ‘তারা তোমাকে সাহায্য করবে না। নির্বোধ হয়ো না।’
‘হ্যাঁ,’ সে বলল। ‘তারা আমাকে সাহায্য করবে। ওহ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমাদের মৃতেরাই আমাকে সাহায্য করবে!’
‘তাহলে এনরিককে একবার দেখ,’ বললেন লেফটেন্যান্ট। ‘দেখ, সে তোমাকে সাহায্য করে কিনা। গাড়ির পেছনে আছে সে।’
‘সে আমাকে সাহায্য করছে,’ বলল মারিয়া। ‘তুমি কি দেখছ না যে, সে আমাকে সাহায্য করছে? ওহ ধন্যবাদ তোমাকে, এনরিক। ধন্যবাদ!’
‘কী হলো,’ বললেন লেফটেনেন্ট। ‘এতো দেখি মাথা-খারাপ। জিনিসপত্রগুলোর পাহারায় চারজনকে রেখে যাও, আমরা একটা ট্রাক পাঠাব ওগুলোর জন্য। এই উন্মাদটাকে আমরা হেডকোয়ার্টারে পাঠাব। ওখানে সে কথা বলুক।’
‘না,’ বলল মারিয়া, তার জামার আস্তিন ধরে। ‘তুমি কি দেখছ না যে, সবাই এখন সাহায্য করছে আমাকে?’
‘না,’ লেফটেন্যান্ট বললেন। ‘তুমি একটা মাথা-খারাপ।’
‘এমনি এমনি কেউ মরে না,’ বলল মারিয়া। ‘সবাই আমাকে সাহায্য করছে এখন।’
‘তুমি তাদের বলো ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সাহায্য করতে,’ বললেন লেফটেন্যান্ট।
আসনের পেছনে নিজেকে শক্ত করে ধরে রেখে সে বসে থাকল। অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাসে উজ্জীবিত মনে হলো তাকে। এটি ছিল সেই একই আত্মবিশ্বাস রউয়েন শহরের এক বিপনী কেন্দ্রে পাঁচশ বছরের কিছু বেশি আগে তারই বয়সের এক মেয়ে যা অনুভব করেছিল।
মারিয়া এ নিয়ে ভাবল না। গাড়ির ভেতরকার অন্য কেউই এ নিয়ে ভাবল না। জেয়ান্নে এবং মারিয়া এই দুটি মেয়ের মধ্যে কোনো মিলই নেই এই তাৎক্ষণিক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসটুকু ছাড়া যা এমন সময় এসেছে যখন তা প্রয়োজন ছিল তাদের। কিন্তু গাড়িতে থাকা পুলিশের লোকগুলো মারিয়ার বিষয়ে অস্বস্তি অনুভব করতে থাকল যখন সে ভীষণ ঋজু হয়ে বসে থাকল আর তার মুখে জ¦লজ¦ল করতে থাকল এক আলোর ধনুক।
গাড়িগুলো চলতে শুরু করল। সামনের গাড়ির পেছনের আসনে লোকগুলো মেশিনগানগুলোকে ভারি ক্যানভাসের বাক্সে ঢোকাচ্ছিল, সরবরাহ যা ছিল ঠেলে বের করে রাখছিল আড়াআড়ি পকেটগুলোতে, ব্যারেলগুলো মুঠোয় করে ঢোকাচ্ছিল বড় একটা ঝুলন্ত থলিতে এবং সরু ঢাকা দেওয়া পকেটটিতে ঢোকাচ্ছিল ম্যাগাজিনগুলোকে।
তৃণনির্মিত টুপিপরা নিগ্রোটি বাড়িটির ছায়া থেকে বেরিয়ে এলো এবং প্রথম গাড়িটাকে সালাম ঠুকল। সামনের আসনে উঠল সে। যে দুজন চালকের পেছনে বসেছিল তাদের এবং চারটি গাড়িকে সে প্রধান সড়কের দিকে নিয়ে গেল এবং পথ দেখাতে থাকল সমুদ্রের ধার দিয়ে হাভানার দিকে।
গাড়ির সামনের আসনে ভিড়ের মধ্যে বসে নিগ্রোটি তার শার্টের নিচে জাদুটোনার নীল পুঁতিগুলোর উপর আঙুল রাখল। সে বসে থাকল চুপচাপ, তার আঙুলগুলো ধরে আছে পুঁতিগুলোকে। হাভানা পুলিশের গুপ্তচর হিসেবে চাকুরি পাবার আগে সে কাজ করতো ডক শ্রমিক হিসেবে এবং রাতের এই কাজটুকুর জন্য সে পাবে পঞ্চাশ ডলার। হভানায় পঞ্চাশ ডলার এখন অনেক টাকা। কিন্তু নিগ্রোটি টাকা নিয়ে কিছুই ভাবতে পারছিল না। সে তার মাথাটা একটু ঘোরাল, খুব ধীরে, যখন তারা মালেকনের আলোকজ্জ্বল সড়কে এসে পড়ল। পেছন ফিরে সে মেয়েটির মুখ দেখতে পেল, কী গৌরবজ্জ্বল মুখ! আর মাথাটা কেমন টানটান ভাবে উঁচু।
নিগ্রোটি ভয় পেল এবং সারাটা পথ তার আঙুলে শক্ত করে ধরে রাখল জাদুটোনার নীল পুঁতির মালাটিকে। কিন্তু এতে তার ভয় দূর হলো না। কেননা সে এখন এক পুরোনো জাদুর খপ্পরে পড়ে গেছে।