দীর্ঘজীবন বেদনাদায়ক : মুর্তজা বশীর
বরেণ্য শিল্পী মুর্তজা বশীর আজ পা রাখলেন ৮৬ বছরে। তিনি একই সঙ্গে চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট ও ভাষাসৈনিক। ভাষাতাত্ত্বিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কনিষ্ঠ সন্তান মুর্তজা বশীর বর্তমানে অসুস্থ। জন্মদিনের অল্প কিছুদিন আগে কথা বলেছেন তাঁর বর্তমান ভাবনা নিয়ে। বলেছিলেন, ‘দীর্ঘজীবন বেদনাদায়ক। স্ত্রী আমিনা বশীরের মৃত্যুর পর তাঁর কোনো স্পৃহাই বেঁচে নেই।’
জুলাইয়ের এক বিকেলে মনিপুরীপাড়ার ফ্ল্যাটে গিয়ে মর্তুজা বশীরকে পেয়েছিলাম বড় মেয়ে আর ছেলের সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বিকেলের নাশতা সারছেন। মাঝেমধ্যেই অক্সিজেন নিতে হয় কৃত্রিমভাবে। তাই গলার কাছে ঝোলানোই থাকে নলটা।
তবু বরাবরের মতো আড্ডাপ্রিয় মুর্তজা বশীর কথা বলছেন প্রাণখুলে।
বললেন, ‘বেঁচে আছি। ৮৫ বছর পুরো হতে চলল। আমি সব সময় ৯২ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচতে চাইতাম। আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করত, ৯২ বছর কেন? এটা ৯৩ হতে পারে, ৯১ হতে পারে। আপনি একদম ৯২ কেন বলছেন?’
একটু দম নিয়ে শিল্পী বললেন, ‘আমি যখন প্যারিসে ছিলাম, ৭১ থেকে ৭৩। পিকাসো মারা গেল ৭৩ সালে। এপ্রিল মাসে। তাঁর বয়স তখন ৯১। তো আমি দেখলাম, পিকাসোকে তো পেছনে ফেলতে পারব না। সে ক্ষমতাও আমার নেই। তবে অন্তত বয়স দিয়ে তাঁকে ডিঙিয়ে যাওয়া সম্ভব।’
বেঁচে থাকার আকুতি যেমন কণ্ঠে, তেমনি দীর্ঘ সময় ধরে জীবনধারণ করাটাও শিল্পীর কাছে বেদনাদায়ক। বলেন, ‘এখন আমার বয়স হচ্ছে। পৃথিবী থেকে তো চলে যেতে হবে জানি। কিন্তু এটা কতটা বিষাদময়। কতটা বেদনাদায়ক। এটা যখন উপলব্ধি করলাম, তখন আমার মনে হলো, আমি দীর্ঘজীবন চাই না। কারণ, দীর্ঘজীবন অনেক বেদনাদায়ক। আমার পিতামাতা দীর্ঘজীবন পেয়েছেন। আমার বাবা ৮৫ পেরিয়ে ৮৬-তে পা দিয়েছিলেন। তার তিন দিন পর মারা গেলেন। আমার মা প্রায় ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। আমার মনে হয়, এটা খুব বিরল ঘটনা। তাঁদের জীবনে তাঁরা কোনো সন্তানের মৃত্যু দেখেননি।’
নিজের অসমাপ্ত কাজ নিয়ে মুর্তজা বশীর বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, আমার অনেক লেখা বাকি। অনেক আঁকা বাকি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে যখন হাসপাতালে ছিলাম, ডাক্তাররা আমাকে লাইফ সাপোর্ট দিতে চেয়েছিল। তখন আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। মানুষ মরতে চায় না। কারণ, পৃথিবীটা সুন্দর। আর একটা হলো, মায়া। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি এদের ছেড়ে যেতে চায় না। এই মায়ার জন্য আমার কান্না পায়।’
সব কাজ হয়তো শেষ করা যায় না। তাই অনেক স্বপ্নই থেকে যায় অধরা। শিল্পী বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল, আমি সময়কে অতিক্রম করে যাব, আমার চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে। যেসব আমি চিন্তাভাবনা করেছি, এগুলো আমার আঁকা হয়নি। যেসব আমি লিখতে চেয়েছি, গবেষণামূলক লেখা, সেগুলো আমি করিনি। আমার ছয়টা গবেষণামূলক লেখা তৈরি করার কথা। যেমন আমরা যখন প্রাচীন বাংলার আর্টিস্টদের নাম বলি—দিকপাল লামা তারানাথ। তিনি তিব্বত থেকে ষোড়শ শতাব্দীতে এসে ঘটনা বলেছেন একাদশ- দ্বাদশ শতকের। তখন তো অনেক কিছু নাই। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু দিকপাল বলে কোনো আর্টিস্টের নাম আমি পাইনি। বরঞ্চ অন্য অনেক আর্টিস্টদের নাম আছে। রমেশ মজুমদার তাঁর বাংলার ইতিহাস বইতে ১০ কি ১২ জনের নাম নিয়েছেন। আমি আরো কিছু পেয়েছি। ১৪-১৫ জন তো হবেই। এগুলো আমার লেখার ইচ্ছে ছিল।’
আক্ষেপের সুরে বলে চলেছেন, ‘এগুলো লিখতে পারিনি। অনেক কিছু আঁকতে পারিনি। এই জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। যাই হোক, আল্লাহ তখন হয়তো আমাকে জীবন দেন। আমাকে লাইফ সাপোর্ট পর্যন্ত যেতে হয়নি। আমি সারভাইভ করি। তারপর ’১৪ সালে আমার স্ত্রী হাসপাতালে গেলেন। তারপর আমি আঁকব আঁকব করে আঁকতে পারিনি। কারণ, বারবার স্ত্রীর কাছে যেতে হতো। আগে আমি দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতাম। কিন্তু এখন বসে কাজ করার জন্য এই ইজেলটা আমি করলাম, যাতে বসে কাজ করতে পারি।’
এ বছরেরই মে মাসে শিল্পীর সহধর্মিণী আমিনা বশীর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, ৭৭ বছর বয়সে। আমিনা বশীর যে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, সেই একই হাসপাতালে তখন ভর্তি ছিলেন মুর্তজা বশীর। এখন অবশ্য তিনি নিজের বাসায়। স্ত্রী বিয়োগের বেদনা তাঁকে নিস্পৃহ করে দেয়। বলেন, ‘এখন আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আমার আর বাঁচার ইচ্ছা নাই। আমার যেসব গবেষণামূলক কাজ করার কথা, যেসব আঁকার কথা—এসব করার স্পৃহা আর নেই!’