গল্প পড়ার গল্প
বিহ্বলতার গল্প বলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে পড়ছি সেই স্কুলের শেষ আর কলেজের আরম্ভ থেকে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ ঠিক কবে বেরিয়েছিল, এখন মনে নেই। তবে ‘ঘুণপোকা’র আগে পড়েছি ‘উজান’, এরপর আরো পরে ‘পারাপার’, ‘মানব জমিন’, ‘যাও পাখি’ ইত্যাদি। মাঝে ‘ঘুণপোকা’। তারপর তো পড়েই চলেছি। ছোটদের-বড়দের নানা গল্প-উপন্যাস। সেই গঞ্জের মানুষ, ট্যাঙ্কি সাফ থেকে উত্তরের ব্যালকনি, প্রতীক্ষার ঘর... কত গল্প। তিনি তাঁর গল্প নিয়ে আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর প্রবেশ করেন। তিনি আমাদের জীবনের নানা বিহ্বলতার কথা মনে করান। শীর্ষেন্দু অতি সূক্ষ্মতায় জীবনকে দেখতে পারেন। জীবন এখানে নির্ভার মগ্নতার, জীবন এখানে অজ্ঞাত এক আলোয় উদ্ভাসিত। তিনি দার্শনিক। জীবনের প্রতি তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস তাঁর গল্পের দুঃখী মানুষের ভেতর সঞ্চারিত হয়।
‘উত্তরের ব্যালকনি’তে বা ‘গঞ্জের মানুষ’ কেন, তাঁর অনেক গল্পেই আমি তা দেখেছি। দেখেছি উপন্যাসে। ‘উজান’-এ এক ভিখিরির সামান্য খুদকুড়ো ছড়িয়ে দিল বালক, তার কী অসম্ভব গর্জন। বালক মাটিতে ছড়ানো খুদ খুঁটে খুঁটে তুলে দিতে থাকে ভিখিরির বাটিতে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে অনুভব করতে হয়। অনুভব করতে চেয়েছি। তিনি অনুভব করাতে পারেন। তাঁর গল্প আমার ভেতরে অপরাহ্ণের আলো আর বিমর্ষতা নিয়ে আসে। ‘উত্তরের ব্যালকনি’ এক প্রেমের গল্প। দুঃখীর গল্প। ব্যালকনিটি উত্তরে। সংসারটি তুষার আর কল্যাণীর। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে লোকটিকে দেখা যায়। সে বসে থাকে বকুল গাছটির নিচে। এবার গাছে ফুল এসেছে খুব। তলাটি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। সেইখানে নিবিড় ধুলোমাখা ফুলের মাঝখানে লোকটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে। ঘন নীল জামা, খাকি ফুল প্যান্ট, লজ্জাস্থানগুলোতে ছেঁড়া তা। মাথার চুলে জটা, গালে অনেক দাড়ি, গায়ে চিট ময়লা, কনুইয়ে ঘা। সে অরুণ। সে পাগল। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তুষার লোকটাকে দ্যাখে। এখনো চেনা যায় অরুণকে। না, আগের চেহারাটা তেমন মনে পড়ে না। এখনকার অরুণকে সে চিনতে পারে। কেননা সে পাঁচ বছর ওই গাছতলায় বসে আছে।
অফিসে বেরোনোর আগে পানের পিক ফেলতে ব্যালকনিতে এসে তুষার দ্যাখে ওকে। পাগলও একবার মুখ তুলে তাকায় যেন। আগে ওই চোখে ঘৃণা, আক্রোশ, প্রতিশোধের ছায়া দেখত তুষার। এখন কিছুই না। তুষার টের পায় কেবল অবিন্যস্ত চিন্তারাশি বয়ে যায় ওর মাথার ভেতর দিয়ে। শুধুই শূন্যতা। আর কল্যাণী? তুষার চলে যাওয়ার পর পাঁচ বছরের মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তুষারের ভেজা ধুতি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে মেলে দিতে দিতে দ্যাখে আকীর্ণ ধুলোমাখা ফুলের ভেতর বসে আছে অরুণ। পাগল। তার একদা প্রেমিক। অরুণ তাকিয়ে আছে। কল্যাণী স্পষ্ট দেখতে পায়, ফাঁক হয়ে থাকা মুখের ভেতর নোংরা হলুদ দাঁত, পুরু ছ্যাতলা পড়েছে। ওই ঠোঁট জোড়া ছয়-সাত বছর আগে জোর করে কল্যাণীকে চুমু খেয়েছিল একবার। ভাবলে এখন ঘেন্না করে।
কল্যাণী প্রতিদিন শেষবেলায় ঠিকে কাজের লোককে দিয়ে ভাত পাঠায় ওকে। অরুণকে সে কখনো ভালোবাসেনি, সে ভালোবেসেছিল তুষারকে। কিন্তু পাগল হয়ে অরুণ যখন ওই গাছতলায় আশ্রয় নিল, ঘরের মধ্যে তারা দুজন ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত। যদি পাগল ঘরে এসে ওঠে? কী মায়াময় ভালোবাসার গল্প এই ‘উত্তরের ব্যালকনি’। একতরফা ভালোবাসায় ব্যর্থ অরুণের ছিল পৃথিবী হারানোর দুঃখ। সেই দুঃখ তার দুর্বল মাথা সহ্য করতে পারেনি। তাই এসে বসেছিল কল্যাণীদের সংসারের দোরগোড়ায়। আগে সে চিৎকার করত, অব্যক্ত আর্তনাদ করত, এখন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তুষার সমস্ত দিন ধরে কাজের চাপে বিধ্বস্ত হয়ে থাকে। অরুণের প্রতি তার মায়া আছে। আবার সংসার করতে করতে ক্লান্ত তুষার অন্য নারীর কাছে গিয়েও ভালোবাসাহীন হয়েই ফেরে।
এই গল্প জটিল নাগরিক জীবনের। এই গল্প হৃদয়ের অতি অন্তস্তলের। কল্যাণীর ভয় আছে, তুষারের নেই। কল্যাণী চলে যেতে চেয়েছিল এই জায়গা থেকে। তুষার বলেছিল, গিয়ে লাভ নেই, ও খুঁজে খুঁজে ঠিক সেখানে পৌঁছে যাবে। তুষারের খুব মায়া। ভাত দেওয়ার ব্যবস্থা তার। এই গল্পে অনেক মাত্রা। মদ খেয়ে ফেরে তুষার। তার গায়ে মেয়েমানুষের গন্ধ, শার্টে তার লিপস্টিকের দাগ। কল্যাণী কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে ফুরোয়। বাইরে বকুলগাছের তলায় পাগল অনেক অনেক ফুল নখে ছিঁড়ে স্তূপ করেছে। উগ্র চোখে সে ব্যালকনির দিকে তাকায়। ক্ষুধার্ত হয়েছে সে। তুষার নিজে গিয়ে তাকে ভাত খাইয়ে আসে। ডাল-তরকারিতে মাখা কাগজ ছিঁড়ে গেছে। পথের ধুলোয় পড়েছে ভাত। পাগল তাই খুঁটে খাচ্ছে। ক্লান্ত তুষারের বুকের ভেতরে বহু উঁচু থেকে ক্রেন-হ্যামার যেন ধম করে নেমে আসে। এই দৃশ্য সে দেখেছিল একদিন অফিস ফেরতা। সে কোথায় যেন বাঁধা পড়ে আছে। এই জীবন থেকে বেরোতে হবে। মুক্তি, মুক্তি চাই যেন তার।
পাহাড়ে কিংবা সমুদ্রে যেতে ইচ্ছে হয় এই শহর ছেড়ে। একদিন রাতে ভাত দিতে গিয়ে সে অরুণকে জিজ্ঞেস করে, কল্যাণীকে তার দেখতে ইচ্ছে করে কি? জবাব দেয় না পাগল। একদিন তুষার হাত ধরে অরুণকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। কী অসামান্য সেই নিয়ে আসা। কল্যাণী ভয় পায়। আর্তনাদ করে ওঠে। তুষার তাকে অভয় দেয়। পাগলের হাত ধরে সমস্ত ফ্ল্যাট ঘুরিয়ে দেখায়। নিজের সমস্ত সুখের চিহ্ন দেখায়। পাগল দেখেই যায়। তারপর ডাইনিং টেবিলে বসে পেট ভরে খায়। তাকে থাকতে বলে। কিন্তু সে কিছুই না বলে নিজে নিজে নেমে চলে যায় বকুল বিছানো ধুলোয়। কল্যাণী দেখেছে পাগলকে। তার চোখে শুধুই বিস্মৃতি। ভালোবাসায় পাগল হওয়া অরুণের হৃদয় জুড়িয়ে গেছে বকুলতলায় বকুলছায়ায় বসে। সে কল্যাণীকে চেনে না আর, ভাতের জন্য বসে থাকে। তুষারের এত ক্লান্তি কাজে, কল্যাণীর এত প্রত্যাখ্যান নিয়ে বাঁচা, এর ভেতরে যেন আবছায়া এক নদীর পাড়ে বসে আছে পাগল। আধা আলো, আধা অন্ধকার, স্মৃতিময় স্রোত বয়ে যায় অবিরল। পাগলের কোনো ক্লান্তি নেই। সে বসে থাকে। পাঠক, এই গল্প আর শোনাতে পারছি না আমি। বিকেলের নিভে আসা আলোয় পাগলকে দেখছি বকুল ঝরানো ছায়ায়। নদীর পাড়ে। সবকিছু থেকে মুক্তি পেয়েছে এই দুঃখী। নতজানু হই লেখকের কাছে।