চিত্রকলা
ডাডাইজমের প্রতিবাদ
শিল্পের জন্য শিল্প এবং মানুষের জন্য শিল্পচিন্তা- চেতনাগতভাবে এ দুই ধারার মধ্যে ডাডাইজমের প্রতি আগ্রহী শিল্পীরা শেষোক্ত দলের অন্তর্ভুক্ত। এ ঘরানার শিল্পীরা রঙ ও তুলিতে কেবল ক্যানভাসকে রাঙিয়ে তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেননি, বরং সমকালীন ঘুণেধরা সমাজবিশ্বাসের ভিত্তিমূলে তাঁরা একাযোগে প্রবলভাবে আঘাত করেছেন এবং কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন পুঁজিবাদী সভ্যতার পরিচিত মানচিত্র।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রূঢ় অভিজ্ঞতায় তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নেন। পুঁজিবাদের শূন্যতা, দ্বন্দ্ব, অমানবিকতা এ শিল্পীদের চোখে সুস্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছিল। এ ভাবধারার শিল্পীরা মনে করতেন পুঁজিবাদী সভ্যতাই মানুষকে বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। যার কারণে প্রচলিত রাষ্ট্রচিন্তা, সামাজিক বিকাশকে তাঁরা কোনোভাবে মানতে পারেননি। প্রবাহমান স্বচ্ছ ধারণার পরিবর্তে তাঁরা শিল্পে যোগ করেন দুর্বোধ্যতা, যা কখনো অর্থহীন, কখনো উদ্ভট কল্পনার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে হেঁটেছে। কেবল চিত্রকলাতেই নয়, ডাডাইজম একই সাথে সাহিত্য, সঙ্গীতসহ শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে প্রভাববিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এ ধারা শিল্পী-সাহিত্যিকরা সামাজিক অভিঘাতে উজ্জীবিত হওয়ার কারণে তাঁদের জনসম্পৃক্ততা ছিল লক্ষ্যণীয়। ফলে মিছিল, সমাবেশ, রাজনীতি, সঙ্গীত, কবিতা, চিত্রকলার যূথবদ্ধ স্পর্শে ডাডাইজম বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নের শক্তিশালী আন্দোলনে রূপ নেয় এবং বৈশ্বিক আবেদন লাভ করে।
‘ডাডা’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন এটি রোমানীয় শব্দ। রোমানীয় শিল্পী ট্রিস্টান জারা ও মার্সেল জ্যাঙ্কো প্রায়ই ‘ডা’-‘ডা’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। রোমানিয়ার ভাষায় এর অর্থ হলো ‘হ্যাঁ’। জারা ও জাঙ্কোর রোমানীয় ডা-ডা শব্দ থেকে ডাডার উৎপত্তি হতে পারে। আবার অনেকে মনে করেন, ‘ডাডা’ ফরাসি শব্দ। যখন কাভারেট ভলতেয়ার ক্যাফেতে উপস্থিত শিল্পীরা তাঁদের আন্দোলনের উপযুক্ত নাম খুঁজছিলেন তখন সেখানে ফরাসি-জার্মান একটি অভিধান ছিল। সে অভিধান হাতড়েই শিল্পীদের ' Dada’ শব্দটি সবার পছন্দ হয়। ফ্রেঞ্চ ভাষায় ‘ডাডা’ শব্দের অর্থ ' hobbyhorse' বা ‘খেলনা ঘোড়া’। ডাডাবাদ আন্দোলনের আঁতুড়ঘর হিসেবে উল্লেখ করা হয় সুইজারল্যান্ডের জুরিখের নাম । জুরিখের সঙ্গে সঙ্গে এর ঢেউ নিউইয়র্কে গিয়েও পৌঁছে ছিল। ১৯১৬ সালের অক্টোবরে জুরিখের কাভারেট ভলতেয়ার ক্যাফেতে সমমনা শিল্পী, সাহিত্যিকরা আলোচনার মাধ্যমে ডাডাইজমের সূচনা ঘটান। এ আলোচনায় অংশ নেন হুগো বেল, মার্সেল জ্যাঙ্কো, হার্নস রিচটার, জ্যঁ আর্প, ট্রিস্টান জারা, রিচার্ড হিউলসেনব্যাক, সোফি টিম্বার প্রমুখ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ডাডাবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব ব্যক্তিই শিল্পের একাধিক শাখায় যুক্ত ছিলেন। ডাডাইজম এমন একটি মতবাদ যে মতবাদটি একই সময়ে, একই সাথে চিত্রকলা ও সাহিত্যকে সমানভাবে প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়েছিল। ১৯১৬ সালের ১৪ জুলাই ডাডা আন্দোলনের প্রথম ইশতেহার প্রকাশিত হয়। এটি লিখেছিলেন হুগো বেল। ১৯১৮ সালে ডাডাইজমের দ্বিতীয় ইশতেহার লিখেন ট্রিস্টান জারা। অন্যদিকে ১৯২০ সালের ১ জুন বার্লিনে প্রথমবারের মতো `International Dada Fair’-এর আয়োজন করা হয়। এ প্রদর্শনীতে ডাডাবাদী শিল্পীদের দুইশ কাজ প্রদর্শিত হয়েছিল।
ডাডাইজম শিল্পীর স্বাধীনতার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখে থাকে। তাই এ ধারার শিল্পীরা স্বাধীন মতো তাঁদের চিন্তার প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পেতেন। সে সময় সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে এ আন্দোলনের অন্যতম শিল্পী মার্সেল জ্যাঙ্কো বলেছেন, ‘আমরা আমাদের সংস্কৃতির ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সব কিছুই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমরা আবার প্রাচীন অন্ধকারের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলাম।’ ডাডাবাদের আরেক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ট্রিস্টান জারার মতে, ‘ডাডাইজম প্রচলিত সবকিছু নিয়ে সন্দেহ করে।’ যেহেতু ডাডাইজমে বিশ্বাসী শিল্পীদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল, তাই তাঁরা শিল্পীর স্বাধীনতা উপভোগ করে প্রচলিত রীতি-নীতির শৈল্পিক বিরুদ্ধাচরণে মেতে ওঠেন। হাতের কাছে যা কিছু ছিল তাই হয়ে উঠলো তাঁদের শিল্প প্রকাশের মাধ্যম।
কোনো স্বাভাবিক বিষয়কে প্রতিবাদের ছাঁচে ফেলে অস্বাভাবিক করে উপস্থাপনের কাজ ডাডাবাদী শিল্পীরা সযত্নে করে গেছেন। সেকারণেই আমরা ডাডাবাদের চিত্রকলায় খণ্ড খণ্ড বস্তুর উপস্থাপন ও বিক্ষিপ্ততা দেখতে পাই। ডাডাবাদী শিল্পীরা কেউ কেউ মনে করতেন, শিল্পের এই অস্বাভাবিক বিক্ষিপ্ততা তাঁদের সৃষ্টি নয়। বরং সময়ই ছিল বিক্ষিপ্ত ও বিপর্যস্ত। জার্মান শিল্পী কার্ট স্কুইটার বলেছেন, ‘ডাডা আন্দোলনে আমরা কেবল সময়কে তার নিজের ‘প্রতিচ্ছবি’ দেখিয়েছিলাম।’ বিশিষ্ট সমালোচক ক্যারেন ক্যাডমি ডাডাইজমের শিল্পীদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন, ডাডা মানে ‘সব অর্থ’ এবং একই সাথে ‘কোনো অর্থ’ নয়। তাঁর মতে, ‘প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার্য জিনিসপত্রকে তাঁদের শিল্প-নির্মাণে ব্যবহার করে দাদাবাদীরা আধুনিকতার সাইন ও সিম্বলের সমালোচনা করেছেন এবং সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার করেছিলেন।
দাদাবাদী আর্টিস্ট কুর্ট স্ভিটার্স বলেছিলেন, যত যাই করা হচ্ছিল, তবুও সবই ভেঙ্গে পড়ছিল এবং ভাঙ্গা অংশ থেকে নতুন কিছু তৈরি করতে হচ্ছিল।’ যার কারণে অনেকেই ডাডাইজমকে অ্যান্টি-আর্ট, প্রতিশিল্প বলে মনে করতেন। ডাডাইজমের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হলেন লুই আরাগঁ, হুগো বল, আন্দ্রে ব্রেটন, মার্সেল ডাচাম, জ্যঁ আর্প, পল অ্যালুয়ার্দ, জন হার্টফিল্ড, ম্যান রে, জুলিয়াস ইভোলা, হানা হৌক, ফিলিপ সুপাল, মার্সেল জ্যাঙ্কো, ট্রিস্টান জারা, জর্জ গ্রোস, ওয়াল্টার সের্নার প্রমুখ।
১৯১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া ডাডাইজমের জোয়ার ১৯২৪ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। পরবর্তীকালে এ আন্দোলনের গতি ম্লান হয়। কিন্তু ডাডাবাদ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এ আন্দোলনটি সুইজারল্যান্ডে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে ফ্রান্স, আমেরিকা, জার্মানি, রোমানিয়া, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটি মতবাদ নতুন আরেকটি মতবাদ উদ্ভবে সহযোগিতা করে। সময়ের আবর্তনে ডাডাইজমও পরবাস্তববাদসহ পরবর্তী শিল্প আন্দোলনগুলোতে মিশে গিয়েছিল। সে সময়ে ডাডা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী হুগো বল বলেছিলেন, ‘ডাডা শিল্পের একটি নতুন প্রবণতা। এখন পর্যন্ত এটা সম্পর্কে কেউ জানে না। কিন্তু ভবিষ্যতের জুরিখে ডাডাইজম নিয়ে মানুষ আলোচনা করবে।’
২০১৬ সালে বিশ্ববাসী ডাডাবাদের শতবর্ষ উদযাপন করেছে। কেবল জুরিখেই ডাডাবাদের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে দেড় শতাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই উদযাপনই প্রমাণ করে হুগো বলের ভবিষ্যদ্বাণী বৃথা যায়নি; বরং একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শতবর্ষী এ আন্দোলন শিল্পরসিকদের দৃষ্টি ও মনোযোগ দাবি করছে।