গোয়েন্দা নজরদারিতে রবীন্দ্রনাথ
যৌবনের সূচনা থেকে পুলিশের গোপন খাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ছিল। রবীন্দ্রজীবনীকার (দ্রষ্টব্য: ২য় খণ্ড) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন- সরকারের দৃষ্টিতে কবি নিজেও একজন ‘দাগী’ ছিলেন। কলকাতায় থাকার সময় তিনি যখন ঘোড়ার গাড়িতে চেপে রাস্তা দিয়ে যেতেন, সেসময় জোড়াসাঁকোর থানা থেকে পুলিশ হেঁকে জানিয়ে দিত, অমুক নম্বর আসামি যাচ্ছে। অনেক সময় তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্র পুলিশের বিভাগ থেকে খুলে দেখা হতো। মোট কথা, ইংরেজ সরকারের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন সম্পর্কে অনুসন্ধান ও কার্যকলাপের জড়িত ছিলেন তার বিবরণ রয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে।
স্বদেশী যুগ থেকে কলকাতার ঠাকুর পরিবারের অনেক সদস্যই বিপ্লবীদের সমর্থন দিয়েছেন বিশেষত গগনেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ইংরেজ সরকারের ভয় ছিল বেশি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ভারতের বাইরে প্রবাসী বিপ্লবীরা বিদেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র আমদানী করে মুক্তিসংগ্রামের ষড়যন্ত্র করেছিলেন; কবি পরোক্ষভাবে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও সাহায্য করেছেন- ইংরেজের গোপন পুলিশ বিভাগ এরকম আভাস পেয়েছিল। ১৯১৬ সালে জাপান ভ্রমণের সময় প্রবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে কবি সাক্ষাৎ করেছেন বলে পুলিশের ধারণা ছিল। এই বিপ্লবীসহ অন্যান্য বিপ্লবীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কবিকে ব্যবহার করছেন বলেও ইংরেজ পুলিশের উচ্চস্তরের বিশ্বাস জন্মেছিল। ভারতে বিদেশী অস্ত্র ও অর্থ এনে বিপ্লবী তৎপরতা পরিচালনায় কবির ইন্ধনের সন্ধানে আরো বেশি বাস্তবতা ছিল ‘সানফ্রান্সিসকো ষড়যন্ত্র মামলা’।
১৯১৮ সালে পুনরায় কবি আমেরিকা যাত্রার পূর্বে ৯ মে গুরলের মাধ্যমে জানতে পারেন ১৯১৬ সালে আমেরিকায় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তিনিও অভিযুক্ত। অভিযোগ করা হয় কবি জাপান হয়ে আমেরিকা গিয়েছিলেন জার্মানদের অর্থানুকূল্যে। কবি এর প্রতিবাদ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট উইলসনকে চিঠি লিখেছিলেন।
সরকার বিরোধিতায় কবিকে সন্দেহ করার ব্রিটিশরাজের গোয়েন্দা দফতরের আরো কারণ হচ্ছে ভারতবর্ষে তিনিই একমাত্র বিশিষ্টজন ছিলেন যিনি প্রথম থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবিরোধী তৎপরতা প্রদর্শন করেন; কথা বলেন; লেখনি ধারণ করেন। যুদ্ধের সময় উগ্র জাতীয়তাবাদ বিরোধী বক্তৃতার কারণে ব্রিটিশ সরকার কবির ওপর সদয় ছিল না। যুদ্ধ ও যুদ্ধ-প্রচেষ্টার বিরোধিতা কবির জীবনের অন্যতম দিক ছিল। যা স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবাজ ব্রিটিশরাজের পছন্দ হয়নি।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ইউরোপ-আমেরিকায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলেও কবি বিরাগভাজন হন সরকারের। অন্যদিকে নোবেল প্রাইজের পর ‘স্যার’ উপাধি নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন কবি - এই প্রচারণা করা হয় উগ্র ভারতীয়দের তরফ থেকে। শান্তিনিকেতনের ছাত্র শিক্ষক এমনকি রবীন্দ্রনাথ অনেকদিন থেকে পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে ছাত্রদের পাঠ গ্রহণ ইংরেজের দৃষ্টিতে ছিল বিপজ্জনক। ব্রিটিশরাজ গোপন সার্কুলার জারি করে ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে। এটি কার্লাইল ও রিজলী সার্কুলার হিসেবে পরিচিত। সরকারি চাকুরিজীবীর সন্তানরা যেন সেখানে পড়তে না যায় সে সম্পর্কে সার্কুলারে নির্দেশ দেওয়া হয়। এমনকি এই সার্কুলারের দু’বছর আগে ‘হুংকার’(কবিকে উৎসর্গীকৃত কাব্য) কাব্যগ্রন্থের লেখক ও রাজদ্রোহের কারণে জেল খাটা হীরালাল সেনকে শান্তিনিকেতনে চাকরি দেয়ার ফলে (যার জন্য কবিকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছিল) কবিকে পুলিশের নিগ্রহ ও দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এবং হীরালালকে আশ্রম ত্যাগ করতে হয়। তবে ১৯১১ সালের পরে তিনি নিজ জমিদারির সেরেস্তায় কাজ দেন তাঁকে।
১৯১২ সালে ১৭ ডিসেম্বরের আগে (আমেরিকায় যাত্রার পূর্বে) বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে আশ্রয় দিতে সাহসী হননি তিনি। কবিসহ কালীমোহন ঘোষ, ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসুকে পুলিশের উৎপাত সহ্য করতে হয়েছে। কবি-জীবনীকারদের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি কবির গতিবিধি ও কার্যকলাপের ওপর পুলিশের নজরদারি ছিল। তাঁর বিদেশী ডাকের চিঠিপত্র সেন্সরড করা হতো। ব্রিটিশরাজ জানত প্রকাশ্যে কবি সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে কথা বললেও ব্যক্তিগত সম্পর্কে বিপ্লবী কর্মী ও নেতারা তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিপ্লবীরা অনেকেই কবির আশ্রমে ঠাঁই পেয়েছিলেন। গোয়েন্দা সংস্থা লক্ষ করেছিল ১৯০৭ সালে ১৬ আগস্ট ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকায় রাজদ্রোহমূলক প্রবন্ধ লিখে অরবিন্দ গ্রেফতার হলে কবি তাঁকে নিয়ে ‘নমস্কার’ কবিতা লিখেছেন। অরবিন্দের গীতা ও বৈদান্তিক মায়াবাদ ছিল সে যুগের সন্ত্রাসবাদীদের প্রেরণার অন্যতম প্রধান উৎস।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় ‘ভারতরক্ষা আইন’(১৯১৫) এবং পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিপ্লবী যুবকদের মুক্তির জন্য কবির সভাসমাবেশে বক্তৃতা ও বিবৃতি এবং লেখনি পুলিশের নজর এড়ায়নি। ইংরেজ রাজত্বের আমলে বিশেষ করে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ও কবির নাইট উপাধি ত্যাগের পর তিনি ইংরেজ সরকারের খুবই বিরাগভাজন হন। বলাবাহুল্য পাঞ্জাবের হত্যাকাণ্ড ও ভারতে ইংরেজের পাশবিক দলননীতিতে কবির মন ঔপনিবেশিক পরাধীনতা সম্পর্কে অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। ১৯২০ সালের এপ্রিলে ইউরোপ যাত্রার অভিজ্ঞতায় বিভিন্ন পত্রে তার সাক্ষ্য রয়েছে। ইংলন্ডে ৫ জুন পৌঁছে তিনি কোথাও আন্তরিক সংবর্ধনা পাননি। তবে তিনি সুহৃদ পেলেই পাঞ্জাবের নৃশংস ঘটনা সবিস্তারে শুনিয়েছেন। কিন্তু ৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ওপর আলোচনা পত্রিকায় প্রকাশিত হলে কবি মর্মাহত হন। ডায়ারকে বাঁচানোর চেষ্টা ছিল বক্তাদের কণ্ঠে।
কবি বলেন- ‘বৃটিশ জাতির নাড়ীতে ঘুণ ধরেছে; তার মজ্জা এই দারুণ বিষের প্রতিক্রিয়ায় জর্জরিত হতে চলেছে।’(১৯২০, ২২ জুলাই, লন্ডন) ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ইংলন্ড ত্যাগ করে ফ্রান্সে পৌঁছান ৬ আগস্ট; ১৩ আগস্ট| ১৯২০-২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে যে সব ছাত্র-যুবক, বিশিষ্ট ব্যক্তি কলেজ ও সরকারি চাকরি ছেড়ে যোগদান করেন তাদের সুরুলের কুঠিবাড়িতে আশ্রয় দেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনে প্রথম সারির বিপ্লবী নেতাদের গমনাগমন ও কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ পুলিশের নথিভুক্ত বিষয় ছিল। ১৯১৮ সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর ভিন দেশী ছাত্র-শিক্ষকদের আগমন ও অবস্থান দেখে পুলিশ মনে করেছিল বিপ্লবীরা এখানে অনুপ্রবিষ্ট ও আশ্রিত। নেপাল মজুমদার জানিয়েছেন- ‘বিপ্লবী নেতা ও কর্মীদের শান্তিনিকেতনে যাতায়াতও বৃদ্ধি পায়।(অসহযোগ আন্দোলনের পর) কয়েকজন প্রখ্যাত বিপ্লবী শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের কাজে নিযুক্ত হন। ডক্টর ভূপেন দত্তের মতো খ্যাতনামা কয়েকজনের কাছে প্রস্তাবও পাঠানো হয় অধ্যাপনার জন্য। এই সব মিলিয়ে এই সময় রবীন্দ্রনাথ ও ‘বিশ্বভারতী’ সম্পর্কে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স বিভাগের সর্বোচ্চ মহলের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা খুবই বেড়ে যায়। ফলে কবি ও ‘বিশ্বভারতী’র ওপর গোপন পুলিশের খুবই কড়া নজর রাখা শুরু হয়। কবির দেশী বিদেশী সমস্ত ডাকের চিঠিপত্র সেন্সর হতে থাকে। কবি তাতে খুবই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হন। একবার কবি স্বয়ংই তা প্রায় হাতে-নাতে ধরে ফেলেন এবং রামানন্দ বাবুর হাতে তথ্যগুলি তুলে দেন।’(রবীন্দ্রনাথ : কয়েকটি রাজনীতিক প্রসঙ্গ, পৃ ২১৮)
১৯২৫ সালের মার্চ মাস নাগাদ ইংরেজ সরকারের গোয়েন্দা নথিতে রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ত্যাগের কারণ বর্ণনা করা হয় অসহযোগের সমর্থক হিসেবে।(রবীন্দ্রনাথ: কয়েকটি রাজনীতিক প্রসঙ্গ, পৃ ২২০) এমনকি এন্ড্রুজ ও পিয়র্সনকে ব্রিটিশবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাঁদের বেআইনি, ষড়যন্ত্রমূলক, বিপদজনক রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে পুলিশের কাছে খবর ছিল বলে উল্লেখ করা হয় রিপোর্টে। পুলিশি তৎপরতা কেবল কবি ও শান্তিনিকেতনের ওপর সীমাবদ্ধ ছিল না তাঁর কবিতা নিয়েও তাদের মন্তব্য করতে দেখা যায়। বাংলা সরকার ১৯২৪ সালের ২৫ অক্টোবর ‘বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স’ জারি করে বিপ্লবীদের দমন ও সুভাষচন্দ্র প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। কবি তখন আর্জেটিনায়। সেখান থেকে খবর শুনে একটি কবিতা লিখে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় পাঠান। ১৯২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর লিখিত ‘পূরবী’র সেই কবিতা ছিল পুলিশের পৈশাচিক তাণ্ডবলীলার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ।
এ সম্পর্কেও ১৯২৫ সালের ২০ মে ডিআইবি রিপোর্ট যায় সরকারের কাছে। কবি ব্রিটিশ বিরোধীকে আশ্রয় দেন তার কথাও রিপোর্টে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের আশ্রয় দিচ্ছেন এ ধরনের রিপোর্ট রয়েছে ১৯২৫ সালের ৭ মে গোপন নথিতেও। তবে কবির শেষ জীবন পর্যন্ত শান্তিনিকেতন সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে বিপ্লবীদের অবস্থান, যাতায়াত যোগাযোগ নিশ্চিত হয়েও সেসব ব্যক্তির রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও কার্যকলাপের সঙ্গে কবির সংস্রব বা সমর্থন আবিষ্কার করতে পারেনি পুলিশ। বরং রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে বিপ্লবীরা কবিকে ব্যবহার করেছেন।
১৯২৫ সালের ৪ জুন ডিআইবি বড়কর্তা মিস্টার হজের গোপন রিপোর্টে প্রথম সারির কয়েকজন বিপ্লবীর সঙ্গে কবির সংযোগের কথাও উল্লেখ করা হয়। কেদারেশ্বর গুহ ও ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে কথা বলে শেষে রবীন্দ্রনাথের জানা সত্ত্বেও বিপ্লবীদের আশ্রয় দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ২৪ জুন বাংলা সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের বড়কর্তা মিস্টার মিলেজও ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারি মিস্টার টনকিনসনকে এক পত্রে ঢাকার অনুশীলন দলের অন্যতম প্রধান নেতা নরেন সেনের মে মাসে শান্তিনিকেতনে গমন ও দেখা সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেন। মিস্টার মিলেজ সেখানে ভয়ঙ্কর বিপ্লবীদের অধ্যাপনা ও নানা কাজের বিবরণ দিয়েছেন; রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও গোষ্ঠী পরিচয়সহ। ১৯৩০ সালের পরে বিপ্লবীদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং তাদের কারামুক্তির আন্দোলনে কবির সক্রিয় অংশগ্রহণ তাঁর সম্পর্কে পুলিশি দৌরাত্ম্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। কবি ব্যক্তি হত্যা, ডাকাতি কখনো সমর্থন করেননি কিন্তু দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য নিবেদিত ব্যক্তিদের তুচ্ছ করেও দেখেননি কখনো। তাদের দেশপ্রেম, বীরত্ব, ত্যাগ ও চরিত্র সম্পদের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীনের এই পন্থা তিনি মেনে নিতে পারেননি। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন ছিল কবির; ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে যার প্রতিফলন রয়েছে। তবে বিপ্লব দমনের প্রচার পুস্তক হিসেবে গ্রন্থটি কবি লেখেননি। তাছাড়া বিপ্লব দমনের প্রচার পুস্তকরূপে ব্রিটিশরাজ ব্যবহারও করেনি এটি। কারণ রবীন্দ্রনাথ আজীবন উচ্চকণ্ঠে পশ্চিমের সঙ্গে প্রাচ্যের সম্মিলন চেয়েছেন। উগ্রপ্রাচ্যবাদী ও হিন্দুয়ানীর বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি।
মূলত শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের রাজনৈতিক চরিত্র ও সরকারের প্রতি আনুগত্য সম্বন্ধে ১৯২৫ সালে মার্চে যেসব অনুসন্ধান ও চিঠিপত্র সরকারের কেন্দ্রীয় বাংলা সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতর/ ডিআইবি ও পুলিশের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা তথ্যাদি রেখে গেছেন সেখানে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজ সরকার বিরোধী মনোভাব ও কার্যকলাপের স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে|
এসব রিপোর্টে কবির ইংরেজ বন্ধু এন্ড্রুজ ও পিয়র্সনসহ বিশ্বভারতীতে আগত বিদেশী অধ্যাপক বিশেষত সুইস-ফরাসি অধ্যাপক বেনোয়া, বিশ্বখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ সিলভ্যাঁ লেভি, অধ্যাপক স্টেন প্রমুখ সম্পর্কে পুলিশের অনুসিন্ধৎসা ও জিজ্ঞাসা দৌরাত্ম্যের পর্যায়ে পৌঁছায়। শান্তিনিকেতনে কর্মরত শিক্ষকদের চিঠি সেন্সর করে বহির্বিশ্বের বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্কের হদিশ অন্বেষণ করত ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তারা। পূর্বেই বলা হয়েছে গোয়েন্দা রিপোর্টে শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন ব্যক্তির রাজনৈতিক অভিসন্ধি কার্যকলাপ জেনেও কবির সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি পুলিশ। লর্ড লিটনও গোয়েন্দা পুলিশের রিপোর্ট ভিত্তি করে বিশ্বভারতী সম্পর্কে নেতিবাচক নয় ইতিবাচক মন্তব্য করেন ১৮জুলাই ১৯২৫ সালে। একই বছরের ২৮ নভেম্বর লিটন দ্বিতীয়বার সেখানে যান এবং কবি ও বিশ্বভারতীর ওপর পুলিশি দৌরাত্ম্য অনুমোদন করতে পারেননি। অবশ্য তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষকে সুপারিশ করলেও তিরিশের দশক পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার কবির ওপর খুশি ছিলো না। রবীন্দ্রনাথের একটি ইংরেজি গ্রন্থের প্রকাশ নিষিদ্ধ করা তার উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথের কোনো বাংলা বই নিষিদ্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৩৪ সালের জুন মাসে মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় ইংরেজিকৃত ‘রাশিয়ার চিঠি’র প্রথম কিস্তিটি (On Russia) প্রকাশিত হওয়ার পরই ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে দেয়। কবির জীবদ্দশায় এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়নি। সরকারের এই আচরণে দেশীয় পত্রপত্রিকায় প্রতিবাদ হয়েছে তবে রাজনৈতিক নেতাদের সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। মার্কসবাদ ও সোভিয়েত রাশিয়ার সাফল্যকে ইংরেজ সরকার কখনোই ভাল চোখে দেখেনি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় বিভিন্ন বন্দিশিবিরে এবং দেশের বিভিন্ন জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দিদের প্রতি দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছেন; তাঁদের মুক্তির জন্য জনসভায় যোগ দিয়েছেন; সরকারি কর্তাব্যক্তিদের পত্র লিখেছেন; তার-বার্তা প্রেরণ করেছেন। ব্রিটিশরাজের প্রতিনিধিদের অযাচিত আস্ফালন; প্রশাসনের উস্কানিতে সংঘটিত হাঙ্গামার বীভৎসতা কবিকে পরাধীনতার যন্ত্রণা মর্মে মর্মে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। তিনি সৃজনশীল কর্মের মধ্যে নিমগ্ন থেকেও আমৃত্যু জনগণের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কিছু নিন্দুক ব্যতীত সারা দেশ এজন্য কবিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আর এসব কারণেও তিনি ব্রিটিশরাজের গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন।