গল্প
শাস্ত্রীয় চাঁদ দেখা
এক বসন্তের বিকেলে বাড়ির ছাদে বসে মার্কেস পড়তে পড়তে দোলাতে থাকা পায়ের গোড়ালির দিকে চোখ পড়ল আর আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম পায়ের পাতা থেকে উপরে উঠে আসা রেখাগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট, এমনকি নখগুলোও বেশ পুরু হয়ে উঠেছে, গোড়ালির নিচের চামড়া আরো শক্তপোক্ত হয়েছে। আমি আর অযথা অলস বিকেল ভেবে মার্কেস কোলে নিয়ে ছাদে বসে রইলাম না। নিচে নামতে নামতে আঙুলের কড়ে গুনে, ক্যালেন্ডার মিলিয়ে হিসাব করে দেখলাম গত মার্চে আমার বয়স ২৭ ছুঁয়েছে। বন্ধুরা জন্মদিনে পার্টির আয়োজন করেছিল, কিন্তু তখন বয়স নিয়ে এতটা ধাতস্থ হয়ে ভাবিনি। এখন ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমি ভেতর থেকে কেমন যেন কেঁপে উঠলাম।
এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, মাত্র সেদিন বাবার হাত ধরে এক জানুয়ারির হাড় কাপানো শীতে খুব সকালে শিশির মাথায় করা ফুটন্ত সরষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে প্রথম গেলাম। আর ওই দিন থেকেই আমার শিক্ষাজীবন শুরু হলো। ঠিক যেন তার অল্পকাল পরেই কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে আমার প্রিয় নচিকেতার সেই ঔদ্ধত্য চঞ্চল গানটা গাইলাম- চারদিকে হাততালির রোল পড়ে গেল। আমার গানের পর শাস্ত্রীয় নাচ নেচেছিল যে মেয়েটা, শুনেছি সিলেটের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে হয়েছে তার; এরই মধ্যে দুই সন্তানের জননীও হয়েছে।
সে সময় আমার জন্য পাগল ছিল মেয়েটা; কলেজের ক্যাফেটেরিয়ায় ডেকে নিয়ে শাস্ত্রীয় নাচের মুদ্রা বোঝানোর ফাঁকে ওর নরম হাত দুটো চেপে ধরেছিল আমার হাত। এতক্ষণ গরম কফিকাপ ধরে রাখায় সেই শীতে এক উষ্ণকোমল নারী হাতের স্পর্শ পেয়েছিলাম; মেয়েটাকে ভুলে গেলেও তার কোমল হাতের স্পর্শ ভুলতে পারিনি, হয়তো কখনো ভুলবও না! তখন আমি এতটাই ভীত আর গর্ধব ছিলাম যে, কলেজের পড়াশোনার ব্যাপারেই চট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না, আর সে অবস্থায় জীবন সঙ্গিনী ঠিক করে ফেলার মতো এমন সিদ্ধান্ত! সে তো ভাবতেই আমার এখনো একশ চার জ্বর উঠার জোগাড় হয়।
মেয়েটা সত্যিই সুন্দর ছিল; তন্বী, প্রিয়দর্শিনী, লাস্যময়ী, ছন্দময়ী, হৃদয়গ্রাহী যা-ই বলি না কেন, সব বিশেষণই তার পক্ষে একদম মানানসই। তা ছাড়া এটা তো সর্বজন বিদিত যে, নাচ জানা মেয়েদের শরীর অনেক ছন্দময় হয়। এখনো কি সে আগের মতো হ্যাংলা পাতলা আছে? হাটার সময় বাতাসে ছন্দ তোলে? কী জানি, বহুবছর হয় তার কোন খোঁজ রাখিনি!
মেহগনি কাঠের আলমারির পাশে টাঙানো আয়নায় নিজের মুখোমণ্ডলটা ভালো করে দেখলাম; না, চেহারাটা ঠিকই আছে, টগবগে যুবক বলতে যা বোঝায় এখনো আমি তাই। কিন্তু বয়স নিয়ে অযথা চিন্তটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছে না। অযথাই বা বলছি কেন? বাঙালির গড় আয়ু হিসাবে জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় নারীসঙ্গহীন অবস্থায় পার করে ফেলেছি। ঐশরিয়া, ক্যাটরিনা, দিপিকা, সানি লিয়ন ভেবে লম্বা সময়ের গোসল আর উৎভ্রান্তের মতো রাস্তায় হাঁটার দিন শেষ; আমার আজই বেরিয়ে পড়া উচিত সত্বর একজন সঙ্গিনী জোগাড় করতে; কথাটা খারাপ শোনালেও, অন্তত এই একলা শীতের রাগগুলোতে কম্বল গরম করার জন্য।
সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে জ্বালিয়ে মারা দুষ্টু প্রকৃতির ওই ফটোগ্রাফার মেয়েটাকে ফোন করলাম। কুশল বিনিময় শেষে হঠাৎ করেই অদ্ভুত এক আবদার করে বসলাম, যেটা শোনার জন্য হয়তো তার কোনো রকম মানসিক প্রস্তুতি ছিল না- কোনো রকম ভূমিকা-ভনিতা না করে সোজাসুজি আজ সন্ধ্যায় শাড়ি পরে আমার সাথে সাক্ষাতের প্রস্তাব দিলাম। জবাবে সে যেন কথা হারিয়ে ফেলল। আমি নিজেও ভাবিনি যে এতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে তাকে এই কথাগুলো বলতে পারব এবং বেহায়ার মতো তার মত শোনার আশায় ফোনটা কানে ধরেই রাখব!
প্রস্তাবটা করা মাত্রই তার কথাবার্তায় এক আশ্চর্য পরিবর্তন অনুভব করলাম। মুহূর্তেই মুখের উত্তরহীনতা নারী সুলভ ছলচাতুরিতে আচ্ছন্ন হলো আর আমাকে সেই ছলচাতুরির জালে বাঁধতে চাইল।
ঈশ্বরকণার মতো নারীর মনও চিরকাল অনাবিষ্কৃত থাকবে আর পুরুষরা সারাজীবন তা আবিষ্কার করেই যাবে। নারীর এই রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে তার শরীরের খুব সাধারণ অথচ আশ্চর্য মোহনীয় বাকগুলোর মতো ইচ্ছা আর স্বভাবের অদ্ভুত সব বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পেয়ে প্রতিমুহূর্তে চমৎকৃত হতে হয়। নারী এক অদ্ভুত প্রাণী, আপনাকে প্রবলভাবে চাইবে, অন্য কারো কাছে যেতেও দিবে না আবার সহজে ধরা দিলে গ্রহণ করবে না। তবে এটাও ঠিক যে, তার এই অদ্ভুত চরিত্রটা না থাকলে হয়তো এতটা প্রবলভাবে পুরুষ তাকে পেতে চাইত না।
ছলচাতুরি কেন বলব না? সারাদিন ফেসবুকে আমাকে জ্বালিয়ে মারে, সাক্ষাৎ করার জন্য পাগল অথচ আজ অযথা ইনিয়ে-বিনিয়ে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে। ‘আজ নয়, অন্য দিন হলে হয় না? শাড়ি পরতেই হবে? আমার নার্ভাস লাগছে, ভয় করছে, আজ থাক; আমাকে নিরস্ত্র করতে হাজারটা কথা বলে চলল। তবে মনের কথাটা আমি ঠিক ধরে ফেললাম; ও চাইছে, আমি বারবার করে বলব আর ও হাজারটা খোড়া অজুহাত দাঁড় করাবে; তবুও আমি একটা একটা করে নাকচ করে ওকে দেখার বাহানায় অবিচল থাকব। আমি করলামও তাই, তার কোন ছলচাতুরি গ্রাহ্য করলাম না, দৃঢ়চিত্তে বললাম : তোমার যত কাজই থাক, আজ আমি তোমাকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখতে চাই, তুমি আমার জন্য অবশ্যই আসবে।
আমার ভয় করছে, মৃদু স্বরে বলল মেয়েটা।
ঠিক আছে, তাহলে আসতে হবে না, চটজলদি বললাম আমি।
না না, আসব, আমার মুখের কথাটা শেষ না হতেই আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল সে। ফোন রাখার পর ফেসবুকে তার বোকা বোকা ছবির দিকে তাকিয়ে একা একা হাসলাম অনেকক্ষণ।
আঁকাবাঁকা গলির শেষ মাথায় যে বাড়িটার চিলেকোঠায় থাকি আমি, ৫ বছর হয় এই একই জায়গায় আছি। শুরুতে এই বাসারই অন্য একটা ফ্লোরে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে থাকতাম। নিজেদের মধ্যে বনিবনা হলো না বলে কিছুদিন বাদে ওরা যার যার পথ দেখল, রয়ে গেলাম কেবল আমি। বাড়িটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেল, ব্যাচেলর হলেও মতের মিল থাকায় বাড়িওয়ালার সাথে ভালো সখ্য গড়ে উঠল, স্থানীয়দের সাথে সম্পর্ক কেবল বেড়েই চলল, জড়িয়ে পড়লাম এক অদৃশ্য মায়ায়। তা ছাড়া, এই বাসার ছাদ, টবের শিউলি গাছটা, ছাদের পায়রাগুলো, এমনকি মোড়ের দোকানের চায়ের কাপগুলোও আমাকে যেতে দিল না। পরিবর্তন বলতে শুধু ফ্লোর পাল্টে একার পক্ষে উপযুক্ত চিলেকোঠায় উঠলাম। এখন আমি এই বাসার চিলেকোঠার সেপাই। এখন এখানে থাকতে আর ভাড়া বাড়ি বলে মনে হয় না, মনে হয় যেন নিজের বাড়ি। মাসান্তে ভাড়া দিতে গেলে ঠাট্টা করে বাড়িওয়ালি বলেন, অনেক দিন তো হলো, এবার ব্যাচেলার নামটা ঘোচাও, আর কতদিন বাইরের খাবার খাবে!
বাইরের খাবার আমার সয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিলে মিনিট দশেকের পথ বড় রাস্তার মোড়, ওখানকার একমাত্র হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টটার পূর্ব কোনের টেবিলটাই আমার ডাইনিং। ৩০ টাকা হলে সকালে তিনটে তেল ছাড়া পরোটা, একটু সবজি আর পর্যাপ্ত জল পাওয়া যায়। দুপুরটা অফিসের ক্যান্টিনেই কেটে যায়, বিকেলে ফেরার পথে ৩২ রকমের মসলা মাখানো ঝলসানো মুরগি আর একটা নান রুটি। রাতের খাবারের জন্য আবার আয়োজন করে যাওয়া লাগে হোটেলটায়; করলা ভাজি, শুটকি ভর্তা, মুরগির ঝোল, গরু ভুনা, রুই, টাকি; শেষ বেলায় যা পাই তা দিয়েই রাতের খাওয়া সেরে ফেলি। তারপর ফিলিস্তিনিতে বোমা পড়ল কেন, ইরানের ওপর নতুন করে কি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলো, আমাদের কোন মন্ত্রী নতুন কি হাসির তত্ত্ব দিলেন, এখন টক অব দ্য কান্ট্রি কী, এসব বড় বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার চিলেকোঠায় পৌঁছাই।
মাঝরাতে ইউটিউবে শাস্ত্রীয় সংগীত জানা শিল্পীদের আধুনিক গান শুনতে ভুল করি না। কেননা, ‘শাস্ত্রীয়’ বিষয়টার প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা তো আছেই সেই নবীনবরণের দিন থেকে। যদিও ওটা ছিল শাস্ত্রীয় নাচ, কিন্তু ‘শাস্ত্রীয়’ শব্দটার প্রতি ভালোবাসা থেকে আমার মধ্যে এই ধারণা পোক্ত হয় যে, শাস্ত্রীয় সব শিল্পকলাই মনের খুব গভীরে দাগ কাটতে পারে, যেমনটা আমার কেটেছিল সেই কাঁচা বয়সেই।
গান শুনতে গিয়ে আমার হলো তাই, যেসব শিল্পীর গান খুব ভালো লেগে যায়, খোঁজ নিয়ে দেখি তারা প্রত্যেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন, এখনো কেউ কেউ করেন পর্যন্ত। একলা রাতগুলোতে কবির সুমন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, রাহাত ফতে আলী খান, এ আর রহমান নয়তো পৌলমী গাঙ্গুলীর নতুন কোনো গান ছেড়ে দিয়ে এক কাপ গরম কফি হাতে নির্জন ছাদে চলে যাই; খোলা জানালা দিয়ে রাতের নির্জনতায় মিলিয়ে যায় সেই গানের সুর। দলছুট বড় বড় ডানাওয়ালা অচেনা পাখি হঠাৎ উড়ে যায়। বাড়িগুলোর জানালায় তখনো ফিলামেন্টের আলো জ্বল জ্বল করে। কোনো কোনো রাতে ভরা পূর্ণিমা নিয়ে পূর্ণচাঁদ আমার কফিকাপে উকি দেয়। নির্জনতা আর ক্লাসিক সংগীতে একটুও ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আমি নিঃশব্দে চুমুক লাগাই। তখন মনে হয়, কেউ পাশে থাকলে হয়তো মৃদু স্বরে বলা যেত, আজ চাঁদটা বাড়াবাড়ি রকম উজ্জ্বল, তাই না?
মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দৈনিক পত্রিকাগুলো, পাতাগুলো যার আরো বেশি এলোমেলো, টেবিলের ওপর রাখা অগোছালো বইপত্র, এমনকি দিনের পর দিন ওয়াড্রোবের না ধোয়া কাপড়গুলোও আমার আলসেমির পরিচায়ক। আলসেমি করতে করতে আমি ভয়ানক রকম অলস হয়ে গেছি। এখন বুঝতে পারছি, একজন শাসনকর্তা বোধ হয় আমার দরকার যে অন্তত কাজগুলো সময়মতো করতে আমাকে উৎসহ জোগাবে। সেই শূন্যতা থেকেই বোধহয় সকালের অদ্ভূত ফোনকলটা করে ফেলেছি।
রাতের রুটিনমাফিক ছাদে পাঁয়তারা শেষে ঘরে এসে ফেসবুক খুলে বসি। আর কিছু ঘটুক আর না ঘটুক, একটা ইনবক্স ম্যাসেস আমার জন্য নিশ্চিত অপেক্ষা করবে; শুভ সন্ধ্যা, কেমন গেল আজকের দিনটা? বুঝতে বাকি থাকে না ম্যাসেসটা আরো ছয় সাত ঘণ্টা আগের। কিন্তু, প্রদানকারীর ছবির পাশে গাড় গোল সবুজ চিহ্নটা জানান দেয় সে এখনো উত্তরের অপেক্ষায় অনলাইনে আছে : গেল, আগের মতোই।
আজ বোধ হয় খুব ব্যস্ত ছিলেন, অনেক রাত করে এলেন যে!
বলতে পার, তো ..., তোমার কেমন গেল?
আর বলবেন না, ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। কী বিভৎস সব মৃতদেহ, ছবি তুলতে গিয়ে একদম ভয় পেয়ে গেছি। পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ এত ভয়ানক ভাবে কুঁকড়ে যায়, আমার জানা ছিল না। লাশগুলো দেখে কেমন গা ছমছম করছিল।
হ্যা, আসলেই বিভৎস! কিন্তু কী আর করা, আমাদের গোটা ব্যবস্থাটাই এমন বিভৎস নোংরা হয়ে গেছে। কেউ ওদের কথা ভাবে না। আমরাও যে এত গলা বড় করি, আমরাও কী ভাবি? এমন কিছু ঘটলে বরং দ্রুত রিপোর্টার পাঠিয়ে খবরটা প্রচার, প্রকাশের ব্যবস্থা করি, তোলপাড় হয়, কিন্তু পরিবর্তন হয় না কিছুই। লাভের মধ্যে খবরটা বিক্রি করে আমাদের পকেটে কিছু পয়সা আসে, এই যা।
আপনি খুব সহজে কঠিন সত্য বলতে পারেন। আপনার এই গুণটা সবার চেয়ে আলাদা।
আরে না না, এমন গুণ অনেকেরই আছে, তোমার সাথে তাঁদের সখ্য নেই বলে এমন মনে হচ্ছে। এ আর কী এমন বিশেষ গুণ!
এরপর কোনো কথা নয়, কেবল একটা হাসির ইমো আসে। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে সে আবার বলে; লাশগুলো দেখে আমার সত্যিই খুব ভয় হচ্ছিল।
এক কাজ করো, তুমি এই ফটো সাংবাদিকের চাকরিটা বরং ছেড়ে দাও, তোমার মন নরম, এসব তোমাকে দিয়ে হবে না। তুমি বরং ফুল, পাখি, প্রকৃতি এসবের ছবি তোল, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে ঠিক জায়গা হয়ে যাবে।
ইনসাল্ট করছেন!
আরে না না, তা কেন করব। আমি সিরিয়াসলি বলছি।
কিন্তু, আপনার মতো সাংবাদিকের তো এমন কথা বলা মানায় না। ... বছর দুই আগে আপনার একটা সেমিনারে গিয়েছিলাম, তখন তো নতুনদের খুব উৎসহ দিয়েছিলেন। যদিও আপনিও খুব বেশি পুরনো নন তখন; সত্যি বলতে কী, তখন অব্দি আমি কেবল শখের ফটোগ্রাফার ছিলাম, আপনার ওই সেমিনারে যোগ দেওয়ার পরই সাংবাদিকতায় নেমেছি।
না না, এসবই ঠিক আছে। আই’ম অনার্ড ফর দ্যাট! কিন্তু, ওই সেমিনারটা ছিল সবার জন্য আর এখন যা বলছি তা শুধু তোমার জন্য!
কিন্তু, কেন? আমাকেই শুধু নিরুৎসাহিত করছেন কেন?
কারণ, আমি চাই না সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তোমার কোনো ক্ষতি হোক।
এরপর ফেসবুকে আর জবাব আসে না, হয়তো কথাটা খুব বেশি ব্যক্তিগত হয়ে গেছে অথবা অনেক বেশি গভীর যে খুব ভেতর থেকে নাড়া লেগেছে, তাই উত্তর কী হবে, গভীর থেকে খুঁজে পেতে দেরি হচ্ছে। আমারও মনে হয়, এটা বলা ঠিক হলো না; কথাটা অনেকটা কনজারভেটিভ হয়ে গেল! অবশেষে আমার অপেক্ষার পরিসমাপ্তি টানে কেবল একটা হাসির ইমো দিয়ে।
অফিসে সারাদিন শব্দ, বাক্য নিয়ে কাটাছেড়া করলেও, রাতে বাসায় ফিরে ফেসবুকে আবার ওই শব্দ চালাচালি করতে মোটেও অস্বস্তি লাগে না আমার। আমাদের চ্যাটালাপ কোনো কোনো দিন সাংবাদিকতার খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে খুব গুরুগম্ভীর বিষয় অব্দি, কোনো কোনো দিন ফটোগ্রাফি প্রশিক্ষণ পর্যন্ত গড়ায়; ভালো ছবি তুলতে হলে ফ্রেমের ভেতর যেকোনো তিনটা বিন্দু, চূড়া অথবা অবজেক্ট খুঁজে নিতে হয়, তবেই সেই ছবিটা হয় অর্থপূর্ণ, দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষণীয়। যেমন, নদীতে ভেসে যাওয়া কোনো পাল তোলা নৌকা ফ্রেমে ধরতে চাইলে সাথে কোথাও একটা চাঁদ অথবা সূর্যকে সাথে নিলে ছবিটা শতভাগ সুন্দর হবে- এসব বিষয় আমি ওর কাছেই শিখেছি।
সন্ধ্যায় আকাশি শিফন শাড়ি পরে যখন সে আমার সামনে এলো, এক সম্পূর্ণা নারী লাগছিল তাকে, সত্যি বলতে কি, তাকে চিনতে আমার বেশ কষ্ট হয়। দেখে অন্য কারো প্রেমিকা বা স্ত্রী বলে মনে হয় আমার; এই মেয়ে কি আমার জন্যই সেজেছে, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কেডস আর জিন্সের প্যান্ট পরে ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে শহরময় দাপিয়ে বেড়ায় যে মেয়ে, এই কি সে! আমি মনে মনে ঈশ্বরকে দোষারোপ করি এই বলে যে, কেন তুমি একে আরও আগে আমার সামনে শাড়ি পরিয়ে আনলে না। এক আশ্চর্য মুগ্ধতায় সেদিন অন্য এক দৃষ্টি আমার মধ্যে প্রকাশ পেল; এতটা নিবিড়ভাবে ওর দিকে কখনো তাকাইনি আমি, যেটা আমাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করল- হাঁটার ছন্দে কোমরের কাছে শাড়ির নড়াচড়া আর সরলরৈখিক হাঁটার ভঙ্গি আমাকে অন্য এক জগতের সন্ধান দিল, যা নিয়ে এত দিন একদম ভাবিনি। ব্যস্ত শপিংমলের ওপর তলার নিরিবিলি রেস্টুরেন্টটার লম্বা মেঝে পেরিয়ে আমার কাছে আসার সময় ওর চোয়াল দুটো খুব ধীরে দু-দিকে প্রসারিত হয়ে এক লাজুক হাসির রূপ নিল; ওহ খোদা, আমি যেন মরে যাই, আরো আগে কেন এমন করে ওকে দেখিনি।
আপনি তো আমাকে সময়ই দিতে চান না, আজ হঠাৎ কী হলো যে আমাকে শাড়ি পরিয়েই ছাড়লেন!
আসলে তোমাকে ডেকেছি একটা কাজে।
কাজে?
হুম, আমার বাসার ছাদে ইদানীং চাঁদটা খুব জ্যোৎস্নান বিলোয় আর থেকে থেকে আমার কফি কাপে উকি দেয়, একা একা চাঁদ দেখে আমার পোষাচ্ছে না, তুমি আমার সাথে চাঁদ দেখবে, আমার বাসার ছাদে? তা ছাড়া, বাইরের খাবার খেতে আর ভালো লাগে না, আমি ভালো তরকারী কাটতে জানি, একটু মসলা মাখিয়ে তুমি ওসব সেদ্ধ করে দিতে পারবে?
এরপর ওর মুখে আর কথা সরে না। এতক্ষণ পটপট করা কণ্ঠ থেমে যায়, গোটা মুখে একটা লাজুক হাসি খেলে যায় আর এতক্ষণ জ্বলজ্বল করা দৃষ্টি নিচের দিকে নেমে যায়। আমি আরো একবার বিস্ময়াভিভূত হয়ে এক আবহমান বাংলার নারীকে আবিষ্কার করি, যার জন্য পাগল হয়েছিল আমার দাদা, বাবা আর আজ হয়েছি আমি।
দিতে পারি, নিয়োগটা যদি সারা জীবনের জন্য হয়।
সেই সন্ধ্যায় জীবনের হাজারও অপ্রাপ্তি ভুলে গেলাম নতুন এই প্রাপ্তির আতিসহ্যে। এলোমেলো জীবনটা গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হলাম। অফিস থেকে সপ্তাহ খানিকের ছুটি নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম সুখের সন্ধানে। বারবার শাস্ত্রচ্যুত হতে চাই না, প্রাপ্তিটাকে শক্ত করে বেঁধে ফেললাম নিজের নিয়তির সাথে। জীবনটাকে এবারই প্রথম অর্থবহ মনে হলো, আর এভাবেই দুজনে শাস্ত্রীয় চাঁদ দেখতে দেখতে মরে যেতে চাই পরম সুখে।
শ্যামলী, ঢাকা, নভেম্বর ২৮, ২০১৪