ফেসবুক লাইভে এসে ক্ষমা চেয়ে কাঁদলেন মেয়র আব্বাস
বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল বসানো নিয়ে আপত্তি তুলে ভুল করেছিলেন জানিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন রাজশাহীর কাটাখালীর পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী। আজ শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ফেসবুক লাইভে এসে তিনি তাঁর ভাইরাল হওয়া অডিও রেকর্ডের বক্তব্যের বিষয়ে ক্ষমা চান। লাইভে তাঁকে কাঁদতেও দেখা গেছে।
আব্বাস বলেন, ‘ম্যুরাল নিয়ে ছড়ানো অডিওটা একটি ঘরোয়া আড্ডার। সেখানে আমি গল্পে কিছু কথা বলেছি, কিন্তু বাস্তবে আমি ম্যুরালের বিরোধিতা করিনি। আমি ভুল করে থাকতে পারি। মানুষই তো ভুল করে। এ জন্য আমি ক্ষমা চাই। কিন্তু আমাকে এ জন্য যে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে তা অনেক বেশি।’
কাটাখালী পৌরসভা সংলগ্ন রাজশাহী নগরীর প্রবেশগেটে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নিয়ে পৌর মেয়র আব্বাস আলীর এক মিনিট ৫১ সেকেন্ডের একটি অডিও গত ২৩ নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে তিনি বলেন, ‘গেটে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল রাখাটা ইসলামি শরিয়ত মতে সঠিক নয়। এজন্য গেটে তিনি বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল রাখবেন না।’ তাঁর এই মন্তব্য ভাইরাল হলে দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার দুপুরে কাটাখালী পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক পদ থেকে আব্বাসী আলীকে অব্যাহতি দেয় পবা উপজেলা আওয়ামী লীগ। বৃহস্পতিবার রাতে জরুরি সভা করে মেয়র পদে আব্বাস আলীর প্রতি অনাস্থা জানান পৌরসভার সব কাউন্সিলর। শুক্রবার বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের জরুরি সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকে আব্বাসকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে তাঁকে স্থায়ী বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠানো হয়। জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অনিল কুমার সরকারের সভাপতিত্বে এই জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। শুক্রবার দিনভর রাজশাহী নগরীতে চলে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ-সমাবেশ।
বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন নিয়ে মেয়র আব্বাস আলীর মন্তব্য নিয়ে সারাদেশে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে, শুক্রবার বিকেলে ফেসবুক লাইভে এসে তা স্বীকার করেন মেয়র আব্বাস। তিনি বলেন, কাটাখালী পৌরসভার প্রবেশমুখে দুটি গেট স্থাপন করা হবে। গেটে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল থাকবে। তিনিই রাজশাহীতে প্রথম এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে দুটি ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করে এ বিষয়ে পৌরবাসীর মতামত জানাতে বলেছিলেন। ফেসবুক লাইভে আব্বাস বলেন, ‘আমি একটা মানুষ, আমি একটা মুসলমান। আমি একটা মানুষ। আমি একটা দল করি। তারপরেও আমি কিন্তু একজন মানুষ, আমি মুসলমান। এই ম্যুরালটা নিয়ে আপলোড দেওয়ার পরে আমাদের ওখানে একটি মাদ্রাসা রয়েছে। জামিয়া উসমানিয়া মাদ্রাসা। .. .. ওই মাদ্রাসার যিনি বড় হুজুর, ওই মাদ্রাসার আমি বিভিন্ন কারণে, মাঝে মাঝে জানাজার কারণে হোক, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কারণে আমার যাওয়া হয়। আমি সেখানে গেলে মাদ্রাসার বড় হুজুরসহ মাদ্রাসার যারা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকরা আছেন, তাদের সাথে মাঝেমধ্যে বসা হয়, কথা হয়। ...মাদ্রাসায় কোনো জানাজায় আমি গিয়েছিলাম। ... জানাজা শেষ করার পরে আমি মাদ্রাসায় গিয়ে বসেছিলাম। .. .. যে মানুষটা বড় হুজুর উনি জামাল উদ্দিন মাহমুদ সন্দিপী। .. .. তিনি আল্লাহওয়ালা একজন মানুষ। এখানে কোনো সন্দেহ নাই। আমি মাদ্রাসায় বসেছি। বসার পরে কথা তুলতে তুলতে, আমার ভিডিওটা তার কিছুদিন আগে আপলোড করা ছিল, আমাকে কথা প্রসঙ্গে একসময় বললেন.. .. ভিডিওটা তো দেখলাম, আমার এক ছাত্র দেখাল, তো ম্যুরালটার বিষয়ে কি কোনো চেঞ্জ আনা যায় না? আমি বললাম যে, কেন হুজুর? ম্যুরালটার বিষয়ে কী সমস্যা? তো আমাকে উনি তখন ব্যাখা করলেন। বিষয়গুলো বললেন। অনেব বিষয়গুলা বুঝাইছেন। আমিও তো মানুষ। তাঁর মতো এতো বড় মানুষের কাছ থেকে আমি শুনেছি। তারপরে.. .. আমি তো একটা মুসলমান। আল্লাহ প্রসঙ্গ আসলে, কোরআনের কথা আসলে কে না দুর্বল হবে? আমিও একটু দুর্বল হয়েছি। সেদিন কিবা তারপরে কোনো এক সন্ধ্যায় .. .. আমি সেদিন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো কটূক্তি করি নাই। অডিওতে আমি বলেছি, এই যে ম্যুরাল নিয়ে, আমি মুর্যালটা করলে ইসলামে ঠিক হবে না। এটা পাপ হবে। আমি এই ম্যুরালটা ওখানে করব না। এইটুকুই।.. মানুষ আড্ডাতে বসে নিজেদের মধ্যে অনেক গল্পই তো করে। আমিও হয়তো করেছি। এটা যদি আমার ভুল হয়ে থাকে, আমি ভুল করেছি। ভুল তো, আমি কতো বড় ভুল করেছি? এই ভুলের জন্য আজকে দেখেন আমাকে ফেসবুকে কতোজন কতো কথা বলছে।’
আব্বাস দাবি করেন, ওই অডিও ভাইরালের জেরে দল থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার পর পৌরসভার সব কাউন্সিলরকে হুমকি দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা জানাতে বাধ্য করা হয়েছে। তাঁর কাটাখালীর দোকানে হামলা করা হয়েছে।
আব্বাস আলী বলেন, ‘আমি তো মানুষ। আমি তো ভুল করতেই পারি। তার জন্য ক্ষমা চাই। তারপরও মনঃপুত না হলে বহিষ্কার করবেন, আমার নামে মামলা দিবেন যতটুকু ভুল করেছি, তার জন্য, কিন্তু একের পর এক অত্যাচার জুলুম। আমার অসুস্থ মা তিন-চার দিন না খেয়ে আছে...আমি কি এত বড় অন্যায় করেছি? অন্যায় করলে তো আইন আছে। এভাবে এত কিছু করা কি ঠিক?... আমাকে বলা হচ্ছে, আমি দলে অনুপ্রবেশকারী। আমি যদি আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য কোনো দল জীবনে করে থাকি তাহলে সব শাস্তি মাথা পেত নেব... কেউ প্রমাণ করতে পারলে আমি সুইসাইড করব।’
লাইভে আব্বাসী আলী সবার কাছে সাহায্য চেয়ে বলেছেন, ‘... যদি মনে করেন, বড় অন্যায় করেছি, আমার পাশে দাঁড়ানোর দরকার নাই। যদি অন্যায় না হয় আমার পাশে দাঁড়ান, অনেক সহযোগিতা চাই। আমার অসহায় মাকে দেখতে দিন। কয়দিন আগে চিকিৎসা করিয়ে এনেছি। চার মাসের বাচ্চার কাছে যেতে চাই। আমার পাশে একটু দাঁড়ান প্লিজ। আল্লাহর ওয়াস্তে দাঁড়ান। ... আমি ভুল করেছি, তার জন্য আইন আছে। আমি আজ কয়েক দিন ধরে না খেয়ে আছি। আমি অসুস্থ হয়ে গেছি। আমাকে হেল্প করুন। আমাকে বাঁচান প্লিজ।’
ভাইরাল ওই অডিও রেকর্ডের জেরে মেয়র আব্বাসের নামে গত বৃহস্পতিবার রাতে বোয়ালিয়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। এর আগে বুধবার দুপুরে পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের জরুরি বৈঠকে আব্বাস আলীকে পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে কেন দলীয় সদস্যপদ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে না, জানতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আর শুক্রবার বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের জরুরি সভায় তাঁকে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করার সুপারিশ করে কেন্দ্রে পাঠানো সিদ্ধান্ত হয়।
আব্বাস আলী রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভায় ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হন। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন।