পদ্মা নদীর ভাঙন অব্যাহত, বুকফাটা কান্না
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বরকান্দি থেকে নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শুরু হয়েছে পদ্মা নদীর ভাঙন। গত এক মাসে পদ্মার ভাঙনে মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পাঁচ শতাধিক বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
ভাঙন অব্যাহত থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে পদ্মাপারের মানুষ। ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তবে ভাঙনরোধে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে শরীয়তপুর পাউবো।
পাউবো ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে নদীতে প্রবল স্রোত সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। জাজিরা উপজেলার বরকান্দি, কুণ্ডেরচর ইউনিয়ন, নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ও মোক্তারের চর ইউনিয়নের প্রায় আট কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন চলছে। গত এক মাসে জাজিরা উপজেলার কুণ্ডের চর ইউনিয়নের ইয়াকুব বেপারীকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ওয়াপদা বাজার, পাঁচটি পাকা মসজিদসহ পাঁচ শতাধিক বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিলীন হয়েছে আরো প্রায় দেড় হাজার একর ফসলি জমি।
আজ শুক্রবার পদ্মা নদীর ভাঙনকবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীপারের স্থাপনা সরিয়ে নিচ্ছে মানুষ। দিশেহারা হয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে তারা। উত্তাল পদ্মার স্রোতের তোড়ে ভেঙে পড়ছে মানুষের ভিটেবাড়ি।
নড়িয়ার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের ফুলমতি বেগম (৫০) মুকে হাত দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নদীর দিকে। অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাঁর। কথা বলতে গেলে কেঁদে ওঠেন। এ অবস্থায় বলেন, সাতদিন আগে তাঁর বসতবাড়িটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নববধূ সেজে এই বাড়িটিতে এসেছিলেন। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল এই বাড়িটুকু। নিজের জীবনের সব স্মৃতি, হারানো স্বজনদের কবরে এখন পদ্মার ঢেউ খেলে। পরিবার-পরিজন নিয়ে একই গ্রামের একটি ভাড়া জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা।
নদীর পাড়ে ষাটোর্ধ্ব এক নারী পদ্মার দিকে তাকিয়ে মুখে আঁচল দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে এভাবেই কাঁদতে দেখা গেল তাঁকে। কাছে গিয়ে নাম-পরিচয় জানতে চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, ‘নাম জাইনা কী করবেন? পারলে আমার বাড়িটা বাঁচান! আমার নাম ফিরুজা বেগম (৬০)। এই যে দাঁড়াইছেন, এইডাই আমার বাড়ি। ভাঙন আতঙ্কে ঘর, গাছপালা কাইটা নিয়া গেছি। অহন বাড়িটার অর্ধেক নদীতে লইয়া গেছে। বারবারই ছুইটা আহি বাড়িটা আছে কি নাই!’
কেবল ফুলমতি ও ফিরুজা বেগমই নন, পদ্মার পাড়জুড়ে এখন শুধুই কান্না আর আহাজারি। ভাঙনকবলিতদের সান্ত্বনা দিতে ছুটে আসছেন তাঁদের স্বজনরা।
গাহেবের চরের আবদুল কাদের মিয়া (৭০) বলেন, ‘বাড়িটুকু ছাড়া আমার আর কিছুই ছিল না। শেষ আশ্রয় বাড়িটাও পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেল।’
শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্য বলেন, প্রতিবছরই এখানে পদ্মানদীর ভাঙনে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীভাঙনে গত বছর শরীয়তপুরে গৃহহীন হয়েছে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি পরিবার। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে আড়াই হাজার একর ফসলি জমি, সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চারটি হাটবাজারসহ বহু স্থাপনা। জাজিরার কুণ্ডের চর থেকে নড়িয়ার সুরেশ্বর লঞ্চঘাট পর্যন্ত আট হাজার ৯০০ মিটার বাঁধ দেওয়া হবে। ১২৯৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে এ এলাকার ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে।
আজ সকালে নদী ভাঙনকবলিত এলকা পরিদর্শনে আসেন শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হোসাইন খান। এ সময় তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ৪২৫টি পরিবারের মধ্যে ২০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। নতুন ভাঙনকবলিত আরো ২০০ জনের তালিকা তাঁরা পেয়েছেন। আজ-কালের মধ্যেই ত্রাণ বিতরণ করা হবে।