মেয়ে-বোন জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী, বিরল রোগ ছেলের
১৩ বছর বয়সী আব্বাস শেখ। এক বিরল রোগ বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। ডান পা ফুলে হাতির মতো আকার ধারণ করেছে। শরীরে দেখা দিয়েছে ঘা, বের হচ্ছে এক ধরনের রস। শরীরে দুর্গন্ধের কারণে বন্ধ করে দিয়েছে স্কুলে যাওয়া।
আব্বাসের বড় দুই বোন ও ফুপু জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী। এর মধ্যে বড় বোন আদুরী বেগম তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।
একমাত্র ছেলে এবং প্রতিবন্ধী মেয়ে ও বোন নিয়ে চরম অসহায় হয়ে পড়েছেন মাদারীপুরের রাজৈর পৌরসভার আলমদস্তার এলাকার রং মিস্ত্রি আবদুর রাজ্জাক শেখ।
আলমদস্তার এলাকায় গিয়ে পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রং মিস্ত্রী আবদুর রাজ্জাক শেখের ৪০ বছর বয়সী বোন ইসমত আরা শারীরিক ও বাকপ্রতিবন্ধী। বিছানাতেই তাঁর জীবনযাপন। ২৪ বছর বয়সী বড় মেয়ে শারমীন আক্তারও জন্মপ্রতিবন্ধী। বিছানাতেই কাটে তাঁর দুর্বিসহ জীবন।
১৭ বছর বয়সী ছোট মেয়ে আদুরী আক্তার প্রতিবন্ধী জীবন কাটিয়ে তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসাতেই মারা যায়।
একমাত্র ছেলে আব্বাস শেখ। জন্মের পর তার পা স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে তার পা মোটা ও ভারী হতে থাকে। ওকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নামি-দামি সব হাসপাতালেই দৌড়াদৌড়ি করেন আবদুর রাজ্জাক শেখ। কিন্তু কাজ হয়নি। দিনকে দিন তার শরীরের অবস্থার অবনতিই হয়েছে। মাঝখানে চলে গেছে পৈতৃক জমিজমা ও বিপুল পরিমাণ অর্থ। অসুস্থ শরীরের কারণে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে আর স্কুলে যেতে পারছে না আব্বাস।
আব্বাস শেখ বলে, ‘আমার পা দিন দিন ফুলে মোটা হচ্ছে আর সারা শরীরে গোটা গোটা হচ্ছে। আবার পা থেকে দুর্গন্ধ রস বের হচ্ছে। তাই স্কুলেও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমার অনেক ইচ্ছে হয় লেখাপড়া করার। অন্য সবার মতো খেলাধুলা করার। লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশের জন্য কিছু করার অনেক ইচ্ছে হয় আমার। কিন্তু আমার দিন দিন যে অবস্থা হচ্ছে জানি না আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরণ করবে কি না। আমার বাঁচতে খুব ইচ্ছে করে। আমি সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই।’
আব্বাসের শারীরিক ও বাকপ্রতিবন্ধী ফুপু ইসমত আরাকে জিজ্ঞাসা করা হলে, আকার ইঙ্গিতে কোনো রকমে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন, চিকিৎসক দেখাবেন তিনি।
আব্বাসের রোগটিকে এলিফ্যান্ট ডিজিজ বলা হয় বলে জানিয়েছেন রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার মণ্ডল। তিনি জানান, জটিল হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বড় হাসপাতালে বিশেষ ধরনের অস্ত্রোপচার ও ওষুধের মাধ্যমে এর চিকিৎসা সম্ভব।
প্রদীপ কুমার মণ্ডল আরো বলেন, ‘আমি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আব্বাস ও ওদের পরিবারের আরো দুজনের শারীরিক অবস্থা দেখাব। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ওদের চিকিৎসার ব্যাপারে কথা বলব।’
রাজৈর পৌরসভার মেয়র শামীম নেওয়াজ মুন্সী বলেন, ‘আব্বাস শেখের পরিবারটি খুবই অসহায়। ওদের তিনজনকে পৌরসভার পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তবে আব্বাসসহ ওদের তিনজনের উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। সরকারিভাবে ওদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে ওরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।’
এদিকে ‘পরিবারের সবার খাবার জোটাতেই কষ্ট হচ্ছে, চিকিৎসা করাবেন কীভাবে?’ বলে মন্তব্য করেন আব্বাসের বাবা আবদুর রাজ্জাক শেখ। তিনি বলেন, জমিজমা যা ছিল সব বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছি। শুধু বসতভিটাই আছে।
আব্বাসের মা আল্পনা বেগম বলেন, ‘ঘরে তিনটি মানুষ মরণব্যধিতে আক্রান্ত। আমার স্বামী রং মিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাতেই হিমশিম খান। ওদের চিকিৎসার জন্য জমিজমা বিক্রি করছি, অনেক টাকা ধারকর্জ করছি। এহন এই বাড়িটুকুই আছে। আমরা এহন কী করুম জানি না। সরকার যদি আমাগো সাহায্য করতে তাইলে আমাগো একমাত্র ছেলে আব্বাস মনে হয় সুস্থ হইয়া যাইত।’
এদিবে আবদুর রাজ্জাক শেখের পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন এলাকাবাসী ও রাজ্জাকের স্বজনরা।
স্থানীয় হালিমা শেখ বলেন, এই পরিবারের তিন ভাইবোন ও এক ফুপু শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়। এক মেয়ে চিকিৎসার অভাবে অনেক আগে মারা গেছে। একমাত্র ছেলে আব্বাসের যে কী রোগ হয়েছে তা কেউ বলতে পারছে না। ওর চিকিৎসার জন্য ওর বাবা অনেক টাকা খরচ করতে গিয়ে জমিজমা হারিয়ে এখন নিঃস্ব।
আরেক বাসিন্দা ফরহাদ বলেন, ছোট্ট আব্বাসের ডান পা ফুলে অস্বাভাবিক আকার ধারণ করেছে। সারা শরীরে ঘায়ের মতো হয়েছে। শরীরে দুর্গন্ধ শুরু হয়েছে। আগে ছেলেটি স্কুলে গেলেও এখন আর যেতে পারছে না। ওর সুচিকিৎসা দেওয়া এই গরিব পরিবারের পক্ষে সম্ভব না। এ জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আমরা চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আব্বাসকে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করুক।
পরিবারটিকে কেউ সাহায্য করতে চাইলে রং মিস্ত্রি আবদুর রাজ্জাক শেখের ০১৯৪৫৬০৫৩৯২ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।