নেত্রকোনার হাওরে চলছে শুঁটকি তৈরির ধুম
সমুদ্রের নোনাপানির শুঁটকির সঙ্গে সবাই পরিচিত। কিন্তু মিঠাপানির মাছের শুঁটকির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন। নেত্রকোনায় হাওরের নদী, বিল ও জলাশয়ের মিঠা পানির তাজা মাছ রোদে শুকিয়ে হাওরপাড়ের জেলে গ্রামগুলোতে এখন চলছে শুঁটকি মাছ তৈরির ধুম। মাছ কাটা, বাছাই এবং শুকানোর পুরো প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে, কোনো ধরনের রাসায়নিক উপকরণ ছাড়াই।
প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি শুঁটকির চাহিদা থাকলেও আর্থিক সংকট এবং স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় হাওরের সম্ভাবনাময় এই খাত এগোতে পারছে না বলে জানান এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা। তাই হিমাগারসহ, ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে প্রয়োজন সরকারি সহায়তা।
স্থানীয় জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় মাছের জোগান পাওয়ায় নেত্রকোনার মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরীসহ সাতটি উপজেলার হাওরপাড়ের অন্তত ৫০টি গ্রামে গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক ছোট-বড় শুঁটকির আড়ত। ভাটি এলাকার প্রায় ৫০ হাজার নারী-পুরুষ এই শুঁটকি তৈরির সঙ্গে জড়িত। শুঁটকির উৎপাদন আরো বাড়াতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন উৎপাদনকারীরা।
হাওর এলাকায় প্রতিবছর অন্তত কয়েক হাজার টন শুঁটকি উৎপন্ন হয়। পুঁটি, বোয়াল, কাকিয়া, চিকরা, টাকি, কেচকি, টেংরা, গজার, শোল মাছ দিয়েই বেশি শুঁটকি তৈরি হয়। সপ্তাহের প্রতি বুধবার ‘ভাটি বাংলার রাজধানী’ মোহনগঞ্জে জমে ওঠে শুঁটকি কেনাবেচার বাজার।
ঢাকা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ভৈরব, সিলেটসহ অন্তত ২০টি জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা মোহনগঞ্জের গুরুহাট্টায় এসে শুঁটকি পাইকারি দামে কেনেন। এরপর তা দেশ-বিদেশের বিভিন্নস্থানে রপ্তানি করেন।
বুধবার গুরুহাট্টার এই শুঁটকি বাজার ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকেই বিভিন্ন জেলার শুঁটকি ব্যবসায়ীরা এখানে এসে পাইকারি দরে শুটকি সংগ্রহ করছেন। আর এই বাজারটিকে কেন্দ্র করে শ্রম বিক্রি করছেন নারীরাও। সংসারের ঘানি টানতে তাঁরা (নারী) স্বল্প পারিশ্রমিকে বিভিন্ন মাছের আড়ত ও বাজারের দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেন বলে জানান শ্রমিক তাসলিমা, সুলতানা ও রহিমা।
বাজারে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার মণ শুঁটকির চাহিদা রয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ী মো. মকরম আলী।
শুঁটকি ব্যবসায়ী জয়নাল মিয়ার কাছে বাজার পরিচালনার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোহনগঞ্জ পৌরসভা থেকে প্রতিবছরের জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বাজারটি নিলামে ডেকে নেওয়া হয়। স্বাস্থ্যসম্মত শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যে এটি তৈরির সঙ্গে জড়িতদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
শুঁটকি উৎপাদন ও বিপণনে জড়িতদের ঋণ দেওয়ার জন্যে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, মোহনগঞ্জ উপজেলার প্রতি বাজারে সপ্তাহে অর্ধকোটি টাকার মতো লেনদেন হয়। কেজিপ্রতি শুঁটকিতে তাঁদের লাভ থাকছে প্রায় ৫০ টাকা।
কিন্তু নিজেদের পুঁজি না থাকায় এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে উৎপাদনে যাওয়ায় নিজেরা লাভবান হতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন শুঁটকি উৎপাদকরা। ব্যাংক ঋণসহ সরকারি সহযোগিতা চেয়েছেন তাঁরা।
মোহনগঞ্জ উপজেলার ঊর্ধ্বতন মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ সাহা জানান, গত বছর পাহাড়ি ঢল আর অতিবৃষ্টির কারণে মোহনগঞ্জের চর হাইজদা বেড়িবাঁধ ভেঙে নষ্ট হয়েছে ডিঙ্গাপোতা, কীর্তনখোলা, পাঙ্গাসিয়া, নাওটানা হাওরসহ জেলার ছোটবড় ১৩৪টি হাওরের বোরো ফসল। এ ছাড়া আগাম বন্যায় ফসল ডুবে ধান নষ্ট হয়ে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। আর অক্সিজেন কমে যাওয়ায় হাওরে বোয়াল, আইর, ইলিশ, পাবদা, মেনি, বাইম, গনিয়া, এবং ছোট মাছের মধ্যে পুঁটি, চিংড়ি, চাপিলা, টেংরা, গুলশা মাছ ও মাছের লাখ লাখ রেণু পোনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ভেসে ওঠে পানিতে।
নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রায় সাড়ে সাতশ কোটি টাকার মাছ এখান থেকে রপ্তানি করা হয় বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য বিভাগ। গতবার জেলায় ৫৪২ টন শুঁটকি মাছের উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. এনামুল হক।
এনামুল হক জানান, গত বছর দুই দফা বন্যার পর মাছের পোনা অবমুক্ত করা ও মাছের বংশ বৃদ্ধির ফলে গতবারের চেয়ে এবার উৎপাদন আরো দ্বিগুণ হবে। স্বাস্থ্যসম্মত শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যে শুঁটকি তৈরির সঙ্গে জড়িতদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শুঁটকি উৎপাদন ও বিপণনে জড়িতদের ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা হচ্ছে। আর শুঁটকির ব্যাপক উৎপাদন এবং এর চাহিদার বিবেচনায় তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপনের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।