ভবনগুলোকে আগুন থেকে বাঁচাতে চান প্রকৌশলী সাব্বির
সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর থেকে দেশে গত পাঁচ বছর ধরে তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রগতি ও এ শিল্পের অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন সাব্বির হোসেন। আর তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে নামের পাশে যুক্ত হয়েছে সার্টিফায়েড ফায়ার প্রটেকশন স্পেশালিস্ট (সিএফপিএস) উপাধি।
অ্যাকর্ড ফর ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটির প্রধান প্রকৌশলী হয়ে সাব্বির চষে বেড়িয়েছেন দেশের নানা প্রান্ত। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পোশাক শিল্পের শত শত কারখানাকে অগ্নিনিরাপত্তার দিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশের অগ্নি নিরাপত্তার ইতিবৃত্ত জানালেন এই প্রকৌশলী। জানালেন, অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রথম বাংলাদেশি তিনি।
দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুগোপযোগী করতে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন সাব্বির হোসেন। কারখানা ও বহুতল ভবনকে অগ্নিনিরাপত্তা দেওয়ার মিশনে অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক নানা স্বীকৃতি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ফায়ার প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশন (এনএফপিএ) ২০১৭ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সাব্বির হোসেনকে সিএফপিএস স্বীকৃতি দেয়। এ ছাড়া তিনি এনএফপিএ ১০১, এনএফপিএ ৭২, এনএফপিএ ১৩ প্রফেশনাল সাটিফিকেট অর্জন করেছেন।
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়ার সন্তান সাব্বির হোসেন নগরীর মেহেদীবাগে বেড়ে উঠেছেন। বাবা আকতার হোসেন ও মা জেরিনা হোসেন শেলির দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় সাব্বির। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি স্কুল ও ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল থেকে প্রাথমিক পাঠ শেষ করে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে এইচএসসি পাস করেন। এরপর গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বিভিন্ন দেশে এক দশক মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল ও প্লানিং নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা ও কাজ করেন সাব্বির।
সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অ্যাকর্ড ফর ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি এবং অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ শুরু করে। অ্যাকর্ডের লিড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সাব্বির হোসেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ঝিনাইদহ, ঈশ্বরদী ও নীলফামারীর রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোতে কাজ করেন। সে সময় তাঁকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়। ভবনের নিরাপত্তার পাশাপাশি শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে সফল হন তিনি।
এ বিষয়ে সাব্বির হোসেন বলেন, রপ্তানিমুখী পোশাক কারাখানাগুলোতে কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার মতো পরিবেশ গড়ে না ওঠায় বেশ চাপের মুখে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সকে কাজ করতে হয়েছে। কারখানাগুলোর মালিকরা নিজেরাই সচেতন হয়ে ভবন ও কারখানায় শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে এটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াত না।
দেশে হাজার হাজার শিল্প কারখানা ও বহুতল ভবনের মধ্যে এখনো অধিকাংশ কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি বলে জানালেন এই প্রকৌশলী। এজন্য রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সেবা সংস্থার মধ্যে সমম্বয় না থাকাকে দায়ী করলেন তিনি। পাশাপাশি সচেতনতা তৈরি না হওয়া, কম টাকায় ভবন নির্মাণ করে রাতারাতি বড় হওয়ার মানসিকতার কারণে অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকি এড়ানো যাচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, দেশে আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। আইনের কঠোরতা থাকলে, সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়লে শিল্প কারখানা ও বহুতল ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা গড়ে উঠত।
অগ্নিনিরাপত্তার জন্য ভবন নির্মাণের সময় প্রকৌশলীর মাধ্যমে ন্যূনতম জরুরি বহির্গমন পথ, অগ্নি শনাক্তরণ এবং ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম, অগ্নিপ্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যেমন ফায়ার এক্সটিংগুইশার, স্ট্যান্ড পাইপ ও হোস সিস্টেম, স্প্রিংকলার সিস্টেম যুক্ত করতে হবে বলে জানান সাব্বির হোসেন। এসবের মাধ্যমে সহজে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। তিনি বলেন, ভবন নির্মাণের সময় প্রকৌশলীর পাশাপাশি ফায়ার সিস্টেমযুক্ত আধুনিক ভবন নির্মাণ করা গেলে বড় ধরনের ঝুঁকি থেকে ভবনকে নিরাপদ করা যাবে।
যদিও দেশে এখনো পর্যাপ্ত সংখ্যক অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানে সংখ্যা হাতেগোনা। তারপরও অনেক তরুণ প্রকৌশলী এই পেশাকে এখন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। এর মধ্যে সফলতাও এসেছে বলে জানালেন সাব্বির।
দেশের ভবন সুরক্ষা অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তরুণ প্রকৌশলীদের নিয়ে সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সলিউশান ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন সাব্বির হোসেন। নিজের প্রতিষ্ঠানে কাজের সঠিক মানদণ্ড এবং নিয়ম অনুযায়ী ফায়ার সেফটি, ইলেকট্রিক্যাল সেফটি, পিএ সিস্টেম, বিল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নিয়ে কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া তরুণ প্রকৌশলীদের এসব কাজে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। এরই মধ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠান এসডিএস ইঞ্জিনিয়ারিং ঢাকায় বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেড, ভিশন গ্রুপ, ব্লু প্লানেট গ্রুপ, জাপান সোলার প্রাইভেট লিমিটেড, এসফ্লাইডার গ্রুপ, এপিলিয়ন গ্রুপ, চট্টগ্রামের ওয়াসা ভবন, বাদশা গ্রুপ, আজিম গ্রুপ, সানম্যান গ্রুপ, ওয়াই ইউএএসএ ব্যাটারির প্রধান কার্যালয়গুলোতে কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বহুজাতিক আরো শতাধিক প্রতিষ্ঠানে চলছে অগ্নিনিরাপত্তার কাজ।
সাব্বির হোসেন বলেন, বর্তমানে ভবন ও কারখানা নির্মাণ ও শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ শতভাগ নিশ্চিত করা গেলে দেশ আরো এগিয়ে যাবে। সেই প্রত্যাশাতেই কাজ করে চলেছেন তাঁরা।