কপোতাক্ষ খননের পর লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে ফলন
‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে’—বাংলা সাহিত্যের অমর মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসে স্মরণ করেছিলেন কপোতাক্ষ নদের কথা। কালের ব্যবধানে নদী শাসন, পলি বিপর্যয়ে মধুসূদনের স্মৃতিধন্য সেই কপোতাক্ষ নদ মৃত হয়ে বর্ষা মৌসুমে সৃষ্টি হতো জলবদ্ধতার, উপচে পড়ত দুই কূল। মানুষের ঘরবাড়িসহ ভেসে যেত ফসলের জমি।
এমন দুরবস্থার মধ্যেও মানুষ স্বপ্ন দেখত, কপোতাক্ষ আবারও জেগে উঠবে। সৃষ্টি হবে জোয়ার ভাটা, ঘুচে যাবে জলাবদ্ধতা। বর্তমান সরকারের ২৮৬ কোটি টাকার কপোতাক্ষ খনন প্রকল্পের মধ্য দিয়ে নদ অববাহিকার মানুষের সে আশা পূরণ হয়েছে।
কপোতাক্ষ নদ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রধান নদ। নদটি যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুরে ভৈরব নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে পাইকগাছা ব্রিজের নিচে শিবসা নদীতে পতিত হয়েছে। তাহেরপুর থেকে পাইকগাছা পর্যন্ত নদটি ১৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত।
কৃষিকাজ, ব্যবসায় বাণিজ্য, নৌ যোগাযোগ ও মৎস্য আহরণের প্রধান কারণ হওয়ায় কপোতাক্ষ নদ এই জনপদের জীবন ও জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ রসদের জোগান দিয়ে আসছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন আমলে রেললাইন নির্মাণের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর পদ্মার উৎস প্রবাহের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার সূত্রপাত হয়। পরে ’৭০-এর দশকে পদ্মা নদীতে ফারাক্কা ব্যারাজের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের ফলে মাথাভাঙ্গা নদী ও কপোতাক্ষ নদের উৎস প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে সাগরবাহিত পলি তলদেশে জমা পড়ার কারণে নদ-নদী ও খালগুলোর নাব্যতা হারিয়ে ফেলে। যার ফলে ২০০০ সাল থেকে শুরু হয় কপোতাক্ষ অববাহিকায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে সৃষ্টি হতো জলাবদ্ধতা, উপচে পড়ত কপোতাক্ষের দুই কূলে। ভেসে যেত মানুষের ঘরদোর, ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটত। বাড়িঘর ছেড়ে মানুষ উঠত স্কুল-কলেজসহ আশ্রয়শিবিরে। জলাবদ্ধতা স্থায়ীরূপ নেওয়ায় নদ অববাহিকার অনেক মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে বসবাস শুরু করে। কৃষক ও জেলে সম্প্রদায়ের মানুষেরা পেশা বদল করে অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়। জলাবদ্ধতায় মরতে থাকে বনজ ও ফলদ বৃক্ষ। এর প্রভাব পড়তে থাকে সুন্দরবনেও। এহেন দুরবস্থার মধ্যেও মানুষ স্বপ্ন দেখত, কপোতাক্ষ আবারও জেগে উঠবে। সৃষ্টি হবে জোয়ার ভাটা, ঘুচে যাবে জলাবদ্ধতা। শুরু হয় ‘কপোতাক্ষ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন’। বর্তমান সরকার ২০১০ সালে কপোতাক্ষ অববাহিকা অঞ্চলে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের ঘোষণা দেয় এবং ২০১১ সালে কপোতাক্ষ অববাহিকার পলি ব্যবস্থাপনার জন্য সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাখিমারা বিলে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বাস্তবায়ন এবং কপোতাক্ষ নদ, বুড়ি ভদ্রা নদ ও কপোতাক্ষ নদের সঙ্গে সংযুক্ত সাতটি খালের খনন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করে ২৮৬ কোটি ব্যয় সাপেক্ষে কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটি ২০১১-১২ অর্থবছরে শুরু হয় এবং প্রকল্পটির ভৌত বাস্তবায়ন শেষ হয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে।
টিআরএম হলো সাগরবাহিত পলি ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রকৌশলগত সমাধান। এর মাধ্যমে সাগরবাহিত পলি টিআরএম বেসিনে জমা পড়ে। পলে প্রকৃতিগতভাবেই নদীর নাব্যতা সংরক্ষিত হয়। পাখিমারা বিলে টিআরএম পরিচালনার কারণে এরই মধ্যে কপোতাক্ষ নদের নাব্যতা ও প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত পাখিমারা বিলে টিআরএম পরিচালিত হবে।
যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার চাকলা ব্রিজ থেকে তালা উপজেলার বালিয়া পর্যন্ত ৮৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে কপোতাক্ষ নদ খনন করা হয়েছে। খনন করা মাটি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নদের দুই তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বর্ষাকালীন পানি নিষ্কাশনের জন্য ১৪টি আউট বক্স-কালভার্ট ও ২১টি পাইপ আউটলেট নির্মাণ (পেরিফেরিয়াল বাঁধ) করা হয়েছে। এ ছাড়া কপোতাক্ষের সঙ্গে সংযুক্ত আরো সাতটি খালের ১১৯ কিলোমিটার খনন করা হয়। যে কারণে কেশবপুর উপজেলার বৃহৎ অংশের পানি কপোতাক্ষ নদের মাধ্যমে দ্রুত নিষ্কাশিত হচ্ছে। কপোতাক্ষসহ সংযোগ খালগুলো খননের কারণে জলাবদ্ধতা মুক্ত হওয়ায় নদ অববাহিকায় এবার লক্ষাধিক হেক্টর কৃষি জমিতে ধান-পাট-সবজিসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন হয়েছে। বেড়ে গেছে কৃষকের কর্মব্যস্ততা। গাছে ধরেছে আম-কাঁঠাল। ঘরছাড়া মানুষ ফিরেছে বসতভিটায়। মাছ ধরতে জাল নৌকা নিয়ে জেলেরা আবার নেমেছে কপোতাক্ষ নদে।
মহাকবি সাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদ কালান্তরে এ জনপদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিকে যেভাবে ধারণ করেছে কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে সমৃদ্ধির সেই ধারা পুনর্জাগ্রত হলো। কপোতাক্ষের বুকে আবার ফিরে এসেছে সেই পুরোনো কপোতাক্ষের মতো ধারা। সযত্নে ধারণ করছে বর্ষাকালীন প্রবাহ। কপোতাক্ষের বুকে ফিরে এসেছে স্রোতধারা। নৌকা মাঝিমাল্লার গান ও জলজীবে প্রাণিকুলের বিচরণ। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যে ঘটেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। বেড়ে গেছে কৃষকের কর্মব্যস্ততা। সাগরদাঁড়িতে কপোতাক্ষের পাড়ে বেড়ে গেছে পর্যটকদের পদচারণা। প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়ন এই জনপদকে চলমান সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের মহাসড়কে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়েছে।
সাগরদাঁড়িতে অবস্থিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আইডিওর নির্বাহী পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, কপোতাক্ষ নদ খননের কারণে এলাকায় জলাবদ্ধতা ও বন্যা হয়নি। যে কারণে ব্যাপক ফসল উৎপাদন হয়েছে। তবে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ চর জেগে যাওয়া জমি দখল করে মাছের ঘের ও খনন করা কপোতাক্ষে মাছ ধরার জন্য কচুরিপনাসহ হাপর দিয়ে পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি করছে এবং সেসব স্থানে এরই মধ্যে পলি জমতে শুরু করেছে।
বরণডালী গ্রামের ফারুক হোসেন জানান, কপোতাক্ষের চাকলা ব্রিজ হতে জীবননগরের মাথাভাঙ্গা পর্যন্ত ৭৯ কিলোমিটার খনন করলে এবং খনন করা কপোতাক্ষে একটি ড্রেজার রেখে সার্বক্ষণিক পলি অপসারণের কাজ করতে পারলে অববাহিকায় ১৫ থেকে ২০ বছর জলাবদ্ধতা সৃষ্টি বা বন্যা হবে না। একই গ্রামের কীরণ মীর বলেন, কপোতাক্ষ অববাহিকাসহ এই এলাকার বৈশিষ্ট্য হলো দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন জীবজন্তু, মাছ, গাছপালা এবং সুন্দরবন। এই এলাকায় দিনে দুবার করে জোয়ার-ভাটা হয় যেটা অন্য এলাকায় হয় না। এ কারণে এই এলাকা রক্ষা করতে হলে আলাদা ব্যবস্থাপনা করা দরকার। আর সে কারণেই প্রয়োজন আলাদা একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান।
কেশবপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সায়েদুর রহমান জানান, কপোতাক্ষ নদসহ সংযোগ খালগুলো খনন করার কারণে অববাহিকায় জলাবদ্ধতা দূরীকরণ হয়েছে। পাখিমারা বিলে টিআরএম পরিচালিত হওয়ায় কপোতাক্ষে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধিসহ জোয়ার-ভাটার সৃষ্ট হয়েছে। কপোতাক্ষের চাকলা ব্রিজ হতে জীবননগরের মাথাভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৯ কিলোমিটার খননের জন্য কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া কপোতাক্ষ নদের সঙ্গে মাথাভাঙ্গা নদীর মাধ্যমে পদ্মা নদীর পুরাতন সংযোগ পুনঃস্থাপনের জন্য সরকার এরই মধ্যে ১৬ কিলোমিটার বাইপাস সংযোগ খননের প্রকল্প অনুমোদন করেছে। বর্তমানে এর বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন আছে। কপোতাক্ষের দ্বিতীয় পর্যায়ের খননকাজ শুরু এবং সমাপ্ত হলে কপোতাক্ষ অববাহিকায় আর কখনো জলাবদ্ধ বা বন্যা সৃষ্টি হবে না।