মুখে কাপড় গুঁজে মোটা লাঠি দিয়ে সাবিনাকে পেটাত
পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলার দেলোয়ার হোসেনের মেয়ে সাবিনা বেগম। দুই সন্তানসহ তাঁকে ছেড়ে গেছেন স্বামী। এমন অবস্থায় বছর খানেক আগে সন্তানদের ভরণপোষণ মেটাতে ও পেটের দায়ে পাশের বাড়ির চাচির পরামর্শে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে রাজধানীতে গিয়েছিলেন তিনি।
ভাগ্য পরিবর্তন করতে ঢাকায় গেলেও সেই যাত্রা সাবিনাকে এনে দিয়েছে স্রেফ দুর্ভাগ্য। গৃহকর্ত্রীর ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে তাঁর ঠাঁই হয়েছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থপেডিক ওয়ার্ডের ৭ নম্বর বিছানায়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হামসাপাতালে গিয়ে সাবিনাকে দেখলে গা শিউরে ওঠে। দীর্ঘদিন ধরে আটকে রেখে নির্যাতন করা চিহ্ন আর দগদগে ঘা তাঁর মাথা থেকে শরীরের সবখানে।
কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান, ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছে সাবিনার ওপর। মাথায় কোপের চিহ্ন ছাড়াও দুই হাতেই ভাঙা আছে অন্তত ছয়টি স্থানে। চিকিৎসা না করানোয় কোনোটিতে অস্বাভাবিক জোড়া লেগেছে আবার কোনোটি লাগেনি।
ধারাবাহিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন পাগলপ্রায় সাবিনা। নিজেই জানালেন প্রায় দুই মাস ধরে চলা ভয়াবহ নির্যাতনের কথা।
জানা গেলো, রাজধানীর ধানমণ্ডির ৯ নম্বর রোডের ১৭ নম্বর বাড়িতে পার্টস ব্যবসায়ী সিদ্দিক আহমেদ টুটুল ও তাঁর স্ত্রী নূরজাহান বেগম রিমা আহমেদের বাড়িতে কাজ নেন সাবিনা। পাঁচ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও তাঁকে দেওয়া হতো তিন হাজার টাকা। মাস তিনেক আগে চা বানানোর সময় তাঁর পায়ে গরম পানি পড়ে। কিন্তু গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী তাঁর কোনো ধরনের চিকিৎসা করাননি। এতে পায়ের লিগামেন্ট কুঁচকে যাওয়ায় সাবিনা সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না। ঠিকমতো কাজ করতে না পারায় শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন।
সাবিনা জানান, ওই বাসার মেম সাহেব তাঁকে ব্যাট দিয়ে পেটাতেন। সামান্য অপরাধে মুখে কাপড় গুঁজে মোটা লাঠি দিয়ে দরজা বন্ধ করে পেটানো হতো তাঁকে। একের পর এক নির্যাতনে হাতের বাহু থেকে শুরু করে কবজি পর্যন্ত অন্তত আটটি স্থানে হাড় ভেঙে যায়। কোনো চিকিৎসা না দেওয়ায় হাড়গুলো এখনও জোড়া লাগেনি। কোথাও কোথাও হাড় বৃদ্ধি হয়ে হাতের স্বাভাবিক আকৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। নির্যাতনের কারণে কাজের সক্ষমতা কমতে থাকলে তাঁর ওপর বাড়তে থাকে নির্যাতন।
সবশেষ সাবিনার বাড়ির সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে মাথায় ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করলে গভীর ক্ষত হয়। এরপর অচেতন সাবিনাকে বাথরুমে নিয়ে দিনের পর দিন আটকে রাখেন গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী।
সাবিনার মা মমতাজ বেগম মেয়ের কোনো খোঁজ-খবর না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে গৃহকর্ত্রীর বাড়িতে যান। প্রথমে দেখতে না দিলেও মায়ের কাকুতি-মিনতির একপর্যায়ে দেখতে দিতে বাধ্য হয়। নিজের মেয়েকে দেখে চিনতে পারেননি মমতাজ বেগম। মেয়েকে এই নির্যাতনের ঘটনা যাতে কাউকে না জানায় তার জন্য হুমকি দেয়।
মমতাজ বলেন, মেয়েকে আনার সময় তাঁর কাছ থেকে সাদা কাগজে এবং স্ট্যাম্প পেপারে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়।
খুলনা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র এডিসি সোনালী সেন জানান, তাঁরা মেয়েটির বিভৎস্য চেহারা দেখেছেন। পুশিশের পক্ষ থেকে তাদের আইনগত সহয়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মেয়েটির পরিবার মামলা করতে সাহস পাচ্ছে না। তিনি জানান, খুলনা পুলিশের পক্ষ হতে বিষয়টি ধানমণ্ডি থানাকে জানানো হয়েছে। মামলা হলে তার কপি ধানমণ্ডি থানায় পাঠানো হবে। এছাড়া নির্যাতনকারীদের নাম-ঠিকানাও ধানমণ্ডি থানায় পাঠানো হয়েছে।
এদিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঘুরে আসার পর পরই বাগেরহাট থেকে মইনুল নামের এক ব্যক্তি এনটিভির এই প্রতিবেদকের কাছে টেলিফোন করেন। নিজেকে মিডিয়া কর্মী দাবি করে তিনি সাবিনার ওপর নির্যাতন নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে নানা অনুরোধ করেন। এছাড়া ঢাকা ও যশোর থেকেও কয়েকজন টেলিফোন করে এই সংবাদটি প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অভিযুক্ত ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান টুটুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান। তবে পরে তিনি ও তাঁর স্ত্রী নূর জাহান বেগম রিমা আহমেদ কোনো কথা বলেননি।