দক্ষিণে এখনও অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম
আজ ২৫ মে। ভয়াল আইলার নয় বছর পূর্তি। এতদিন পরও দেশের দক্ষিণ উপকূলে আইলার আঘাতের দগদগে ক্ষত চিহ্ণ রয়ে গেছে। এর মধ্যেও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। তাদের কাজ নেই। খাবার পানি নেই। চিকিৎসার সুযোগ নেই। যোগাযোগ সংকটে দক্ষিণের বিপন্ন মানুষ যেনো নিজগৃহে বন্দি।
২০০৯ সালে ১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছাস আছড়ে পড়ে উপকূলে। মাত্র ৩০ মিনিটের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় মানুষের সংসার। প্রাণ যায় ৭৩ জনের। সেদিন পানিতে ভেসে যায় গবাদি পশু। ঘুর্ণিঝড়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুন্দরবনও।
আইলার তান্ডবে ১১৭ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। সাতক্ষীরাসহ পার্শ্ববর্তী খুলনা জেলার কয়রা ও পাইকগাছা এলাকার তিন লাখেরও বেশি মানুষ হয়ে পড়ে গৃহহীন। ৩২ হাজার একর জমির চিংড়ি সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। দুই হাজার হেক্টরেরও বেশি কৃষি ফসল নষ্ট হয়ে যায়। বিপন্ন মানুষের আশ্রয় হয় টিকে থাকা উঁচু বেড়ি বাঁধে। এভাবেই টানা দুই বছর কাটে তাদের।
আইলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের মানুষ। ওই এলাকার ৮০ হাজার মানুষ আজও নিজ বাড়ি ঘরে থিতু হতে পারেনি। দুর্যোগও যেন তাদের পিছু ছাড়ছে না। নোনা পানির এ এলাকায় চিংড়ি চাষে মন্দা, কৃষিও নেই। দুই ইউনিয়নের মানুষ তাদের পুরনো পেশা অর্থাৎ বনে কাঠ কাটা, মধু সংগ্রহ ও নদীতে মাছ ধরতে যেতে সাহস করছেন না। জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়ে জেলে বাওয়ালি মাঝি হারিয়েছেন তাদের সঞ্চিত সহায় সম্পদ। কেউ কেউ প্রাণও হারিয়েছেন তাদের হাতে।
২০১০ সালের ১০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্যামনগর সফরকালে ১৯ কোটি টাকা গৃহনির্মাণের অনুদান দেন। কিন্তু গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও শ্যামনগরের ওই সময়কার সংসদ সদস্যের মধ্যকার দ্বন্দ্বের জেরে আইনি জটিলতায় এ টাকা স্থানীয় দুটি ব্যাংকে পড়েছিল দীর্ঘদিন। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় জলবায়ু তহবিল থেকে আট কোটি টাকা ব্যয়ে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা গৃহহীন মানুষকে ঘর তৈরি করে দেয়। ক্ষতিগ্রস্থ বেড়ি বাঁধগুলি মেরামত করা হলেও তা সব সময় ঝুঁকির মুখে। এসব বাঁধ টেকসই নয়। এসব বাঁধ আবারও ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
বছরের বেশির ভাগ সময় কাজ না থাকায় মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এলাকার স্কুলগুলিতেও কমে গেছে শিক্ষার্থী। স্কুলগামী শিশুরা এখন নদীতে জাল টেনে জীবিকা নির্বাহ করে। নোনা পানির ঘেরা টোপে আটকা পড়েছে দুই ইউনিয়নের মানুষ।
পদ্মপুকুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদুল ইসলাম জানান, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের সাইক্লোন শেল্টার (আশ্রয়স্থান) মাত্র নয়টি। প্রতিটিতে আশ্রয় নিতে পারে এক হাজার মানুষ। অথচ এ ইউনিয়নের জনসংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি।
স্থানীয় গণমুখী ফাউন্ডেশনের পরিচালক মো. লুৎফর রহমান জানান, বেসরকারি উদ্যোগে পানি সরবরাহ চলছে। অনেকগুলি পুকুর খনন করা হয়েছে। মা ও শিশুদের নিয়মিত স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আইলা উপদ্রুত এলাকায় একটি হাসপাতাল স্থাপন করা গেলে মানুষের জীবন রক্ষা অনেকটাই সহজ হতো।’
আইলা এলাকার নারীদের কোনো কাজ নেই। পুরুষ সদস্যরা গ্রাম ছেড়ে শহরে উঠে বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজে নিয়েছে। নারী ও শিশুরা এখন নদীতে মাছের পোনা ধরে। পদ্মপুকুর গ্রামের কমলা রানী বলেন, ‘এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। কিন্তু সেখানে কোনো ডাক্তার নেই।’ তিনি বলেন, ‘অসুখ বিসুখে বেঁচে থাকাই কঠিন। সন্তান প্রসবের সময়, ডায়রিয়া, অপুষ্টিসহ নানা রোগে মারা যায় মানুষ।’