ব্রাজিল বাড়িতে একদিন
ফুটবল বিশ্বকাপ মানেই বাংলাদেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা সমর্থকদের উন্মাদনা। দেশে জার্মানি, ইংল্যান্ড, স্পেনসহ অন্য দেশের ফুটবল ভক্তও আছে। তবে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার তুলনায় সেই সংখ্যা কম।
এই উন্মাদনা কখনো রূপ নেয় পোশাকে। আবার কখনো নিজের বাড়ির ছাদে পতাকা উড়ানোর মাধ্যমে। তবে ব্যতিক্রমধর্মী উন্মাদনাও আছে। এই যেমন মাগুরার কৃষক আমজাদ হোসেন। জার্মানির ফুটবল দলের একনিষ্ট এই ভক্ত তাঁর জমি বিক্রি করে মাগুরায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের জামার্নির পতাকা বানিয়েছেন।
তেমনি বাংলাদেশে ব্রাজিল ফুটবল দলের একনিষ্ট এক ভক্ত আছে। তিনি শুধু নিজের বাড়ির ছাদে ব্রাজিলের পতাকা ওড়াননি, পুরো ছয়তলা বাড়ি রং করেছেন ব্রাজিলের জাতীয় পতাকার আদলে। বাড়ির ছাদে লাগিয়েছেন একাধিক ব্রাজিলের পতাকা, এমন কী নিজের গাড়ির সামনেও দিয়েছেন ব্রাজিলের পতাকা। বাড়ির নাম দিয়েছেন ব্রাজিল বাড়ি। এক কথায় তিনি ব্রাজিল ফুটবল দলের অন্ধ ভক্ত। তাঁর এই বাড়িটি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার লালপুরে অবস্থিত।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার লালপুরে ব্রাজিল বাড়ির সামনে জয়নাল আবেদীন টুটুল। ছবি : এনটিভি
ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে না হওয়ায় গতকাল মঙ্গলবার রওনা দেই ব্রাজিল বাড়ির উদ্দেশে। তার আগে মুঠোফোনে কথা বলে নিই ব্রাজিল বাড়ির মালিক জয়নাল আবেদীন টুটুলের সঙ্গে। তিনি আমাকে তাঁর বাড়ি দেখার আমন্ত্রণ জানান।
বেলা ১১টার দিকে ঢাকার ধানমণ্ডি থেকে যাত্রা শুরু করি ঠিকানা পরিবহনের বাসে চেপে। প্রায় দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাই সাইনবোর্ড এলাকায়। সেখানকার একটি মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে রওনা দেই ফতুল্লার উদ্দেশে। ফতুল্লা থেকে রিকশায় করে পৌঁছাই লালপুরের সেই ব্রাজিল বাড়িতে। সময় তখন দুপুর ২টা।
পথে কয়েকবার ফোনে যোগাযোগ হয় জয়নাল আবেদীন টুটুলের সঙ্গে। বাড়ির সামনে যাওয়ার পর মনে হচ্ছিল পুরো বাড়িটি যেন ব্রাজিলের পতাকায় মোড়ানো। বাড়ির ছাদে পতপত করে উড়ছিল ল্যাটিন আমেরিকার দেশটির পতাকা। আর সবার ওপরে উড়ছিল লাল সবুজের বাংলাদেশের পতাকা।
ব্রাজিল বাড়িতে আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন জয়নাল আবেদীন টুটুল। বাড়ির নামফলকে সোনালি অক্ষরে লেখা ‘ব্রাজিল বাড়ি’। সাথে রাশিয়া বিশ্বকাপের লোগো।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার লালপুরে ব্রাজিল বাড়ির সামনে জয়নাল আবেদীন টুটুল। ছবি : এনটিভি
বললাম, কেমন আছেন ভাই?
ভালো আছি।
রাস্তায় আসতে কোনো অসুবিধা হয়েছে কি না?
বললাম, না। কোনো অসুবিধা হয়নি।
ভেতরে বসেন। আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসি।
এই বলে জয়নাল আবেদীন টুটুল আমাকে বাড়ির ভেতরে নিচতলায় নিয়ে যান। নিচতলায় একপাশে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। সেখানে ছিল ব্রাজিলের পাঁচবার বিশ্বকাপ নেওয়ার স্বর্ণালি ছবিগুলো।
জয়নাল আবেদীন টুটুল আমাকে বসতে দিলেন তাঁর বসার ঘরে। বাড়ির প্রতিটি দরজায় ছোট করে ব্রাজিলের পতাকা। চাবির রিং, বাড়ির দেয়াল, ছাদ সব কিছুতেই ছিল হলুদ আর সবুজের ছোঁয়া। বসার ঘরের সবকিছুতেই ছিল ব্রাজিল প্রীতির নিদর্শন। এমন কী নিজের সংগ্রহে রেখেছেন বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রতীকী ট্রফিও।
কিছুক্ষণ পর জয়নাল আবেদীন টুটুল ফ্রেস হয়ে আসেন। পরেছিলেন ব্রাজিলের জার্সি। কথা প্রসঙ্গে জানান, সর্বপ্রথম ২০১০ সালে তাঁর বাড়ি ব্রাজিলের পতাকার আদলে রং করিয়েছিলেন। তখন বাড়িটি ছিল দোতলা। ২০১৪ সালে ছয়তলা বাড়ির কাজ শেষ হওয়ার পর আবার ব্রাজিলের পতাকার আদলে রং করান। স্মৃতি হিসেবে ওই দুটি ছবি রেখে দিয়েছেন বসার ঘরে। রয়েছে ব্রাজিলের পতাকা সম্বলিত চায়ের কাপ ও স্যান্ডেলও। তবে সেই স্যান্ডেল কেউ পরেন না। শুধু সাজিয়ে রেখেছেন ঘরে।
জয়নাল আবেদীন টুটুলের কাছে প্রশ্ন ছিল, ব্রাজিল ভক্ত হলেন কবে থেকে?
ফুটবল বোঝার পর থেকেই ব্রাজিলের ভক্ত। তবে ২০০২ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জেতার পর এই ভালোবাসা আরো বেড়ে যায়। সেবার দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। ব্রাজিলের রোনালদো সর্বোচ্চ আটটি গোল করেন ওই বিশ্বকাপে। এরপর থেকে ব্রাজিলের প্রতি ভালো লাগা শুরু হয় টুটুলের।
ব্রাজিল বাড়ি সম্পর্কে জানতে চাইলে জয়নাল আবেদীন টুটুল বলেন, ‘আসলে আমি ফুটবল খেলা বোঝার পর থেকেই ব্রাজিল সমর্থন করে আসছি। আগে বাসার ছাদে ব্রাজিলের পতাকা উড়াতাম। ২০১০ সালে চিন্তা করলাম ব্যতিক্রমধর্মী কী করা যায়। সে ভাবনা থেকে প্রথম আমাদের দোতলা বাড়িটি ব্রাজিলের জাতীয় পতাকার রঙের আদলে রং করাই। তারপর ২০১৪ সালে এই আমাদের এই ছয়তালা বাড়িটিকে রং করা হয়। এটি আমার পুরোপুরি ব্যক্তিগত উদ্যোগে।’
ব্রাজিলভক্ত টুটুল বলেন, ‘আমার কাছে ২০০২ সালের ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্তটি সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়।’
‘খেলায় হার-জিত আছে। তবে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির সঙ্গে ব্রাজিলের এমন হার আমি কোনোভাবে মেনে নিতে পারিনি।’ বলছিলেন টুটুল।
ব্রাজিলের প্রিয় তারকা সম্পর্কে জয়নাল আবেদীন টুটুল বলেন, ‘আমি কালো মানিক পেলে ও নেইমারের বড় ভক্ত। জীবনে একবার যদি তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ অথবা তাঁদের কাছ থেকে একটি করে ব্রাজিলের জার্সিতে স্বাক্ষর নিতে পারতাম তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। আমার জীবনের সকল আশা পূর্ণ হতো তাতেই।’
এদিকে ব্রাজিল বাড়ি ও ব্রাজিল ভক্ত টুটুলের কথা এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে ঢাকায় ব্রাজিলের দূতাবাসে। দূতাবাসের কর্মকর্তারা টুটুলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে কথাবার্তাও বলেছেন।
জয়নাল আবেদীন টুটুল বলেন, ‘আমি গত ৩ মে বেলা ১১টার দিকে আমার ছেলে আবদুল কাদের শান্ত, ছোট ভাই মো. রিজান হোসেন রনি ও ব্রাজিল ভক্ত সাইদুর ফাহিমকে নিয়ে ব্রাজিলের দূতাবাসে যাই। সেখানে দূতাবাসের সহকারী রাষ্ট্রদূত জুলও সিজার সিলভার সঙ্গে আমাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়। আমি তাঁকে বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়নে কাজ করার আহ্বান জানাই। সে সময় ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত জোয়াও তাবারা দেশের বাইরে থাকায় তাঁর সঙ্গে আমার মুঠোফোনে কথা হয়। জোয়াও তাবারা আগামী ২২ জুন তাঁর স্ত্রীসহ ব্রাজিল বাড়ি পরিদর্শনে করবেন বলে জানিয়েছেন তাঁর পিএস। সে সময় তাঁর সঙ্গে ব্রাজিলের একটি প্রতিনিধিদল ও ব্রাজিলের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সদস্যরাও থাকবেন বলে জানতে পেরেছি।’
জয়নাল আবেদীন টুটুলের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। দেশীয় ফুটবলের উন্নয়নের কথা ভেবে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় ‘বাংলাদেশ চ্যারিটি ফুটবল ফেডারেশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন ।
বাংলাদেশের ফুটবল প্রসঙ্গে টুটুল বলেন, বাংলাদেশের পক্ষেও সম্ভব আগামী দিনগুলোতে ভালো ফুটবল খেলা। চেষ্টা করলে আমরাও বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করতে পারব। আর এ জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক পর্যায় থেকে ভালো করে ফুটবল প্রশিক্ষণ দেওয়া।
অবশেষে বিদায়ের পালা। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিদায় নেই ব্রাজিল বাড়ি থেকে। বিদায়ের সময় ব্রাজিল বাড়ির ছবি সংবলিত একটি মগ উপহার দেন জয়নাল আবেদীন টুটুল।