চিকিৎসকের গাড়ির চাপায় মৃত্যুর দুয়ারে যুবক
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. আনিসুর রহমানের প্রাইভেট কারের চাপায় আহত যুবক শাহীন কাদির এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
গত ৩ জুন গাড়ি চালানো শেখার সময় শাহীনকে চাপা দেন ডা. আনিস। এরপর ১৫ দিনেও শাহীন কাদিরের চেতনা ফেরেনি।
শাহীন কাদিরকে বর্তমানে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, শাহীন কাদিরের মস্তিষ্কের ক্ষমতা ৭৫ ভাগ বিলুপ্ত হয়েছে। আঘাতজনিত কারণে মাথার ঘিলু নির্গত হয়েছে। কয়েকটি স্নায়ু বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তপাত হয়েছে। ভেঙে গেছে মেরুদণ্ডের উভয় স্কন্ধের হাড়। স্পাইনাল কর্ড ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে। সারা শরীর থ্যাতলানো শাহীন কাদিরের লিভার বড় হয়ে গেছে।
হাসপাতালে অচেতন, বাকরুদ্ধ সন্তানকে নিয়ে শাহীন কাদিরের বাবা এসএম মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলেটির জীবন বিপন্ন। সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। লাইফ সাপোর্ট খুলে দিলেই তার জীবনবায়ু শেষ।’ তিনি ডা. আনিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান।
শাহীন কাদিরের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডা. আনিসুর রহমান গত ৩ জুন বেপরোয়াভাবে নিজের প্রাইভেটকার চালিয়ে শ্যামনগরের দিকে যাচ্ছিলেন। অন্যদিক থেকে, শাহীন কাদির তাঁর বন্ধু হাবিবুর রহমানের মোটরসাইকেলে করে কালীগঞ্জ উপজেলার দিকে যাচ্ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শ্যামনগরের খানপুরে ফিলিং স্টেশনের কাছে একটি ছোট কালভার্টের ওপর ডা. আনিসের প্রাইভেটকার শাহীন কাদিরকে চাপা দেয়। তাঁকে গুরুতর আহত দেখেও ডা. আনিস তখন সরাসরি শ্যামনগরের দিকে পালিয়ে যান। গ্রামবাসী এ সময় তাড়া করেও তাঁকে ধরতে পারেনি।
এমনকি শাহীন কাদিরকে শ্যামনগর হাসপাতালে ভর্তি করলেও ডা. আনিস তাঁর চিকিৎসায় সাহায্য করা, এমনকি তাঁর সামনে আসতেও অস্বীকৃতি জানান বলে তাদের অভিযোগ।
শাহীনের বাবা এসএম মুজিবুর রহমান জানান, তাঁর ছেলেকে শ্যামনগর থেকে সাতক্ষীরায়, পরে খুলনা এবং সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শুরুর আগে ডা. আনিস শাহীনকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় আনতে বলেছিলেন। চিকিৎসার সব খরচ তিনি বহন করবেন বলেও জানিয়েছিলেন। তবে খরচ বহন করা দূরের কথা বরং চিকিৎসার ব্যাপারে কোনো সহায়তা তিনি করেননি বলে অভিযোগ করেন মুজিবুর রহমান।
এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানায়, ডা. আনিসের মালিকানাধীন সাদা রঙের প্রাইভেটকারটি (ঢাকা মেট্রো -গ- ৩৫-১২১১) তিনি নিজে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় গাড়িতে থাকা চালক সোহরাব মোড়ল ডা. আনিসকে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। শেখানোর সময় গাড়ির মধ্যে তাঁরা উচ্চস্বরে হাসিঠাট্টা করছিলেন বলেও তাদের অভিযোগ। তাদের খামখেয়ালির কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তারা দাবি করেন।
শাহীনকে হত্যার উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিতভাবে ডা. আনিস এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে দাবি শাহীনের বাবার।
তবে, নিজের গাড়ি চাপায় দুর্ঘটনার ব্যাপারে জানতে চেয়ে ডা. আনিসুর রহমানের কাছে ফোন করা হলে তিনি দাবি করেন, ওই দিন তিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন না। তাঁর গাড়ির চালক সোহরাব মোড়ল গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শাহীনের জন্য ৫০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন বলেও জানান।
এদিকে শ্যামনগরের অনেক সংবাদকর্মী, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারী ও সাধারণ নাগরিকরা অভিযোগ করে জানান, ডা. আনিসুর রহমান মাদকাসক্ত। তিনি নিয়মিত ইয়াবা খেয়ে থাকেন। তাঁর হাতে কোনো রোগী নিরাপদ নন দাবি করে তারা বলেন, ‘তাঁকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক রিপোর্ট হয়েছে। তাঁর হাতে বহু রোগী মারা গেছে। তাঁর দাপটে শ্যামনগর হাসপাতালে কোনো ভালো চিকিৎসক টিকতে পারছেন না।’
তবে ডা. আনিস এসব অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, তিনি মাদকাসক্ত নন।
এদিকে প্রাইভেটকার চাপায় গুরুতর আহত হওয়ার পরও শ্যামনগর থানা পুলিশ শাহীনের বাবার দেওয়া মামলা নেননি। এলাকাবাসী জানায়, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে ডাক্তার আনিসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ওই ওসি বিভিন্ন সময় ডা. আনিসের গাড়ি ব্যবহারও করে থাকেন বলে তারা জানিয়েছে।
পুলিশ মামলা নিতে অস্বীকার করায় পরে এসএম মুজিবর রহমান সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সহযোগিতা কামনা করে আবেদন করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্যামনগর থানার ওসি সৈয়দ মান্নান আলী বলেন, শাহীন কাদিরের পরিবার কোনো এজাহার দেয়নি। এখনই এজাহার দিলে তিনি তা রেকর্ড করবেন বলে জানান।
এসএম মুজিবুর রহমান জানান, চিকিৎসার শুরু থেকে এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ১২ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। এসব টাকা তিনি জমি বিক্রি করে, বন্ধক রেখে ও সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছেন। এখন প্রতিদিন ছেলের পেছনে তাঁকে ২৫ হাজার টাকা করে ব্যয় করতে হচ্ছে।
মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আমি আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য আপনাদের কাছ থেকে মানবিক সহায়তা চাই।’
শাহীন কাদির সম্প্রতি কৃষি ডিপ্লোমা শেষ করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করছিলেন।