৮২ প্রতিশ্রুতি দিয়ে লিটনের ইশতেহার ঘোষণা
লক্ষাধিক মানুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ ৮২টি প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন।
আজ মঙ্গলবার প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর আগে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করা হয় নির্বাচনী ইশতেহার।
বেলা সাড়ে ১১টায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের নৌকা প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে আসেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ডাবলু সরকার। এরপর দুপুর ১২টার পর পরই মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। মহাজোটের শরিক দল এবং নগরীর আওয়ামী লীগপন্থী বিশিষ্ট নাগরিকদের উপস্থিতিতে লিটনের পক্ষে তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার পাঠ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ড. আব্দুল খালেক।
মেয়র নির্বাচিত হলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহীর উন্নয়নে কী কী করবেন, ইশতেহারে ১৪টি দফায় এমন ৮২টি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ইশতারের ১৪ দফার প্রথমেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কর্মসংস্থানকে। এতে গ্যাস সংযোগের মাধ্যমে নগরীতে গার্মেন্টস শিল্প, চামড়া শিল্প, বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা এবং বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক দ্রুত বাস্তবায়ন করে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির স্বপ্ন দেখিয়েছেন লিটন। রেশম কারখানা ও টেক্সটাইল মিল পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর পাশাপাশি আম, টমেটো, আলু প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পাটশিল্পের মতো কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। রাজশাহী জুটমিল সংস্কার ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি কুটির শিল্পের উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত ও সহায়তা করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চান লিটন।
শিক্ষানগরী হিসেবে খ্যাত রাজশাহী নগরীতে শিক্ষা নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছেন লিটন তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে। মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত বাস্তবায়ন, পূর্ণাঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সার্ভে ইনস্টিটিউটকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর, নতুন একাধিক বালক ও বালিকা স্কুল-কলেজ স্থাপন, পূর্ণাঙ্গ সংগীত, আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী মহাবিদ্যালয় স্থাপন, রাজশাহী হোমিওপ্যাথি কলেজ ও হাসপাতালের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ও মান উন্নয়ন করে ভর্তি সমস্যার সমাধান করতে চান লিটন। পাশাপাশি রপ্তানিমুখী বিশেষ কারিগরী প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন, বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষা শিক্ষার জন্য সার্টিফিকেট কোর্স চালু, পুরো নগরীর নাগরিক কেন্দ্রগুলোকে ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চান তিনি। নগরীতে আগত শিক্ষার্থীদের আবাসিক ও নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
ইশতেহার অনুযায়ী মেয়র নির্বাচিত হলে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন এক হাজার শয্যার হাসপাতাল দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চান লিটন। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং মাতৃসদন স্থাপন করে নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবেন মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি খায়রুজ্জামান লিটন। দ্রুত শেষ করতে চান নিজের প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী শিশু হাসপাতালের নির্মাণকাজ। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত পানি শোধনাগার প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে নগরবাসীর জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করতে চান তিনি। এ ছাড়া বস্তিবাসীর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পানি, পায়খানা, ড্রেন, রাস্তা, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি করে জীবন মানের উন্নয়ন সাধন করতে চান লিটন।
প্রস্তাবিত পানি শোধনাগার প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করে নগরবাসীর বিশুদ্ধ খাবার পানিও সরবরাহ করতে চান লিটন। বস্তিবাসীর জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে তাদেরও জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে চান তিনি।
ইশতেহারে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য বহুতল বিশিষ্ট ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণ করে সহজ কিস্তিতে মালিকানা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, আলেম ও সাংবাদিকদের জন্যও পৃথক আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
লিটনের নির্বাচনী অঙ্গীকারে গুরুত্ব পেয়েছে শহরের অবকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়টিও। এর মধ্যে নগরীর চারদিকে রিং রোড ও লেক নির্মাণের ঘোষণা এসেছে। নগরজুড়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গণশৌচাগার নির্মাণ, অনুন্নত এলাকার রাস্তাঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নগরীর বসতবাড়িতে শতভাগ গ্যাস সংযোগ প্রদান, পিপিপির আওতায় অসমাপ্ত প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন, যানজট নিরসনে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে ফ্লাইওভার এবং ওভারপাশ নির্মাণ, নগরীর ঐতিহাসিক স্থানগুলোর উন্নয়ন করে পর্যটনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স স্থাপন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, পুরাতন বাজারগুলোর আধুনিকায়ন ও নগরীর সম্প্রসারিত অংশে বাজার গড়ে তোলা, প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠ স্থাপন এবং শিক্ষা ও চিত্তবিনোদনের জন্য বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করে চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন লিটন। এ ছাড়া রাজশাহীতে পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন কেন্দ্র চালুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তাঁর ইশতেহারে। আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত দৃষ্টিনন্দন দুটি মডেল মসজিদের কাজও দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চান লিটন।
খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র থাকাকালে নির্মল বাতাসের শহর হিসেবে সারা বিশ্বে সুনাম কুড়ায় রাজশাহী। এবার মেয়র নির্বাচিত হলে রাজশাহীর এই গৌরব পুনরুদ্ধার করে বৃক্ষশোভিত রাস্তার ডিভাইডার স্থাপনের কাজ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন লিটন তাঁর ইশতেহারে। নগরীতে খাস পুকুরগুলো উদ্ধার করে উন্নয়নের মাধ্যমে সেগুলোর সংরক্ষণ, প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে পুকুর সংরক্ষণের পাশাপাশি পরিবেশের সুরক্ষায় নগরীতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন লিটন। নগরীর প্রতিটি সরকারি ভবন চত্বরে ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং নগরীতে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইকেল প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে লিটনের নির্বাচনী ইশতেহারে।
মেয়র নির্বাচিত হলে রাজশাহী-ঢাকা বিরতিহীন ট্রেন এবং রাজশাহী-কলকাতা ট্রেন চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন লিটন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পদ্মা নদীর প্রাণ ফেরাতে চেয়েছেন তিনি। নতুন নতুন সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে সাবেক এই মেয়রের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা মার্কেট নির্মাণেরও ঘোষণা এসেছে ইশতেহারে। এসবের বাইরে ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নয়ন, প্রবীণ নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত, প্রবীণ নিবাস স্থাপন, প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন, মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, সিটি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা, ইমাম-পুরোহিতদের জন্য উৎসব ভাতা চালু এবং মাদকমুক্ত রাজশাহী গড়ে তোলার স্বপ্ন নগরবাসীকে দেখিয়েছেন লিটন।
মেয়রের দপ্তর নগরবাসীর জন্য সর্বদা উন্মুক্ত রাখার ঘোষণা দিয়ে ইশতেহারে লিটন নগর ভবনকে নগরীর প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া নগরীর হোল্ডিং ট্যাক্স যেভাবে বেড়েছে তা কমিয়ে সহনশীল পর্যায়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন লিটন। বলেছেন, এই ইশতেহার বাস্তবায়ন করে তিনি রাজশাহী নগরীকে একটি সমৃদ্ধ নগরী হিসেবে গড়ে তুলবেন।
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বলেন, ‘আমি মেয়র থাকাকালে উত্তরাঞ্চলের অবহেলিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই শহরকে সব সূচকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির যে গৌরব অর্জন করেছিলাম, তা আজ প্রায় শূন্যের কোটায়। আমার সময় রাজশাহী শান্তি, সম্প্রীতি, সমৃদ্ধি আর পরিচ্ছন্ন সবুজের বাসযোগ্য নগরীর মর্যাদা লাভ করেছিল। এগুলো সব অতীত হয়ে গেছে। আজ তা পুনরুদ্ধার করতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান খান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তিবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি শাহীন আক্তার রেনী, সাধারণ সম্পাদক মো. ডাবলু সরকার, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সহসভাপতি তবিবুর রহমান শেখ, আওয়ামী লীগের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির মহানগর সভাপতি লিয়াকত আলী লিকু, সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ প্রামাণিক দেবুসহ ১৪ দলের অন্য নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।