রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্যতা সুরক্ষা অনিশ্চিত
পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্যতা সুরক্ষার জন্য ওই চ্যানেল এবং সন্নিহিত এলাকায় কাটার সাকশন ড্রেজার ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন পরিহারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। সাকশন ড্রেজার ছাড়াই যে যেভাবে পারছে বালু উত্তোলন চলছে। অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে রাবনাবাদ চ্যানেল ও তৎসংলগ্ন মোহনাসহ আশপাশ এলাকায় ভাঙন দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। আর বালু উত্তোলন করে কোটি টাকার বাণিজ্যে নেমেছে কয়েকটি প্রভাবশালী মহল। অভিযোগ উঠেছে, পায়রা পোর্ট কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় এ অবৈধ বালু তোলা ও বিক্রি চললেও অজ্ঞাত কারণে নিজেরাই ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তির নির্দেশনা মানছেন না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের ড্রেজার দিয়ে রাবনাদ চ্যানেলসহ মোহনা এবং ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশের নদী থেকে দেদার বালু উত্তোলনের কাজ চলছে। অন্তত ২০/২৫টি বলগেট দিয়ে এসব বালু বিভিন্ন প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে। বানৌজ শের-ই-বাংলা ও দুটি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের (নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন ও রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড) ভূমি উন্নয়নের লক্ষ্যে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের বালু উত্তোলন নীতিমালা অনুসরণপূর্বক কাটার সাকশন ড্রেজারের মাধ্যমে রাবনাবাদ চ্যানেল থেকে দুটি প্রতিষ্ঠানকে বালু উত্তোলনের নির্দেশনা দেয় পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ বছরের ২৪ মে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) মহিউদ্দিন খান আহম্মেদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এসব নির্দেশনা দেন। যেখানে নৌ কল্যাণ পরিদপ্তর, নৌবাহিনী সদর দপ্তর এবং বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট লিমিটেডকে রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্যতা সুরক্ষা করতে এমন নির্দেশনা চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে। একই চিঠিতে পায়রা বন্দর এলাকায় অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশনা রয়েছে। এমনকি অবৈধভাবে সাকশন ড্রেজার ছাড়া অন্য কোনো ড্রেজার ব্যবহার প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ রয়েছে । কিন্তু এসব নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেল ছাড়াও তার আশপাশে এমনকি আন্ধারমানিক নদীতে নির্মাণাধীন সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুসংলগ্ন এলাকা থেকেও এর আগে বালু উত্তোলন করা হয়। অন্যদিকে রাবনাবাদ চ্যানেল ছাড়া সরকারের নির্দিষ্ট ইজারা দেওয়া বালুমহাল থেকে এভাবে বাইরের ড্রেজার এবং ব্যবসায়ীরা সাব-কন্ট্রাক্টে দেদার বালু তোলায় ক্ষতির শিকার হচ্ছে বালুমহল ইজারাদারসহ সরকার। বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে। আর ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়া, সাকশন ড্রেজার ছাড়া অননুমোদিত প্রতিদিন অন্তত ১০/১৫টি ড্রেজার বালু কাটছে। আর ওই বালু বলগেটবোঝাই করে সরবরাহ করা হচ্ছে, যা পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পরিপন্থী। কেএম বলগেট থেকে বালু ভরাটের কাজ চলছিল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বলগেটের কর্মচারী আলতাফ হোসেন ও আবদুর রহিম জানান, তাঁরা ১০ দিন ধরে বালু এনে এখানে আনলোড করছেন। গলাচিপার খোকন জানালেন, তাদের নিজস্ব ড্রেজার দিয়ে রাবনাবাদ চ্যানেলসহ আশপাশ দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এভাবে সাকশন ড্রেজার ছাড়াই রাবনাবাদ চ্যানেলে প্রতিদিন লাখ লাখ সিএফটি বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। যা পরিবেশবান্ধব কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ দেবপুর এলাকা দিয়ে এর আগে ২০/২২টি লোকাল ড্রেজার দিয়ে বালু কাটায় নদীপাড়ে তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। পরে গ্রামবাসীর প্রতিরোধে বন্ধ করা হয়েছে। যেহেতু রাবনাবাদ পাড় ঘেঁষে একাধিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টসহ কোল টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। সেখানে ফ্রি-স্টাইলে সাকশন ড্রেজার ছাড়া বালু কাটার কারণে রাবনাবাদ এলাকার মোহনা ও সংযোগ নদীর তীরে তীব্র ভাঙন দেখা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আর চ্যানেলের নাব্যতা যথাযথভাবে বজায় রাখতে নির্দেশনা থাকলেও কেন সাকশন ড্রেজার ব্যবহার করা হচ্ছে না, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর এম জাহাঙ্গীর আলম জানান, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পায়রা পোর্ট এলাকায় অবৈধ ড্রেজিং দিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধে কোস্টগার্ডকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র নৌ ও ডিজেল প্ল্যান্ট সেনাবাহিনীকে কাটার সাকশন ড্রেজার ছাড়া বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানকে বালু তোলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে নৌবাহিনীর একটি সাকশন ড্রেজার বিদেশ থেকে এসে রাবনাবাদ নদীতে কাজ শুরু করেছে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মৃত্তিকা উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. ফজলুর হক জানান, দেশীয় পদ্ধতিতে বালু উঠানোর ফলে নদীর গতি প্রকৃতি পাল্টে গিয়ে স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হতে পারে। আর এর ফলে নদীর দুপাশের বনায়নের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শুধু রাবনাবাদ নদীই নয়, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে জেলার অন্যান্য নদীতেও। মাঝেমধ্যে এসব নদীতে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযুক্তদের জেল-জরিমানা করা হলেও অবৈধ বালু তোলা বন্ধ হয়নি এখনো।