শেখ হাসিনা প্রতিনিয়ত আচরণবিধি ভঙ্গ করছেন : রিজভী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিনিয়ত নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নির্মাণ করতে দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আজ শুক্রবার নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
রিজভী বলেন, গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে সশস্ত্র বাহিনীর দেড় শতাধিক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাঠে নামছেন, যাঁদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। গত মঙ্গলবার বিকেলে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তাঁরা এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক বলেন, ‘এরা আপনার (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে দেখা করবেন এবং আপনার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করবেন। এই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নির্বাচনে যুক্ত হয়ে নির্বাচনী কর্মকাণ্ড আরো বেগবান করবেন। আপনি যাতে পরবর্তী সময়ে আবার বিজয়ী হতে পারেন, সে লক্ষ্যে এরাও কাজ করবেন। তারিক সিদ্দিক বলেন, যেমন যাচ্ছে সেভাবে যেন এগিয়ে যাওয়া যায়, ভবিষ্যতে যেন কোনো বাধা না আসে, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আপনাদের একাত্মতা ঘোষণা আমাদের ও দেশবাসীকে শক্তি এবং সাহস জোগাবে। অন্য বক্তরাও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় রাখতে কাজ করার অঙ্গীকার করেন এবং সবাই হাত তুলে সমর্থন দেন।’
রুহুল কবির রিজভী বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আচরণবিধির ১৪ ধারায় বলা আছে, সরকারের সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁর সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনী কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড যোগ করতে পারবেন না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দেড়শ সেনা কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনী কাজ করার যে অঙ্গীকার করেছেন তা কি আচরণবিধি ভঙ্গ নয়? কেননা সেদিনের অনুষ্ঠানটি সরকারি কোনো কর্মসূচি ছিল না। সরকারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এবং রাষ্ট্রীয় ভবন গণভবনকে ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের কর্মকাণ্ড গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে বিতর্কিত করে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রীর এসব নির্বাচনী আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মান হয় যে, সরকার একতরফা ও ভোটারশূন্য নির্বাচনের পথেই হাঁটছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নির্মাণ করতে দিচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রী গত মঙ্গলবার তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রহমানসহ ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন, তা অরুচিকর, অশ্রাব্য ও উসকানিমূলক। তফসিল ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন না। কেননা নির্বাচনী আচরণবিধির ১১ ধারায় বলা আছে, কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা তাদের মনোনীত কেউ বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি উসকানিমূলক বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদান করতে পারবেন না। ওই ধারার উপধারা (ক) তে উল্লেখ আছে, ‘নির্বাচনী প্রচারণাকালে ব্যক্তিগত চরিত্র হনন করে বক্তব্য প্রদান বা কোনো ধরনের তিক্ত (উসকানিমূলক বা মানহানিকর) বক্তব্য প্রদান করতে পারবেন না। যদিও নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী বর্তমানে সব ধরনের প্রচার-প্রচারণা বন্ধ তবু এই উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, তফসিল ঘোষণার পর রাষ্ট্রীয় ভবন গণভবনে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। রিটার্নিং অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে একতরফা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার প্ল্যান করা হচ্ছে বলে আমাদের কাছে খবর এসেছে। নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসার ও বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারদের নানা ধরনের নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনী আচরণবিধির ১৪(২) ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী গণভবনের মতো একটি রাষ্ট্রীয় ভবনে থেকে জনবিরোধী কার্যকলাপ এবং জনগণের ভোটারাধিকার হরণের ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই করতে পারেন না। এই পরিস্থিতিতে গত তিন দিন আগে বিকেল ৫টায় গণভবনে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) খাত থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১৮ লাখ কম্বল দিতে যাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের নামে কম্বলসহ ত্রাণসামগ্রী আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও তাদের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে বিতরণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগ দেওয়া হলেও শুধু আশ্বাসে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছে কমিশন। নির্বাচন কমিশনের গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করলে বিস্মিত হতে হয়, সত্যি বিচিত্র নির্বাচন কমিশন!
সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, দলবাজ নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কখনোই সাহসী হতে পারবে না। মূলত জাল-জোচ্চুরি-প্রহসনের ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশন সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সুস্পষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রী আচরণবিধি অমান্য করলেও নির্বাচন কমিশন তাতে কর্ণপাত না করে নির্বাচন নিয়ে সরকারের গোপন মিশনগুলোর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করছে। প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন কমিশনের পক্ষে বিধিভঙ্গকারী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কার্যত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। তবে এখনো সময় আছে, নিজেদেরকে সরকারের ছাতার নিচে থেকে বের করে জনগণের ছাতার তলে আসুন। জনগণের হরণকৃত ভোটারাধিকার ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করুন। আশা করবো, বিধিভঙ্গের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করবেন। যদি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচনের চিন্তা করে থাকেন, তবে আপনারা রেহাই পাবেন না। অন্যায় বা অবিচারের পন্থা অবলম্বন করলে দেশের সাধারণ মানুষ তা রুখে দিতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে আপনাদের।
এদিকে রিজভীর অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম আজ দুপুরে আগারগাঁওয়ে অবস্থিত নির্বাচন ভবনে বলেছেন, ‘গণভবন বা বঙ্গভবন ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচার চালালে তা নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন করা হবে। কিন্তু বৈঠক করলে হবে না। তাই সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক আচরণবিধির লঙ্ঘন নয়।’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আপনারা বলেন, আমাদের এখানে যদি কেউ আসে, এসে বলে আপনারা যা করতেছেন, ভালো করতেছেন। আমার বন্ধু, যারা রিটায়ার্ড কর্মকর্তা, যারা কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত না। তারা এসে বলল, দোস্ত যা করছিস, ভালো করছিস। ভবিষ্যতে যেন এ রকমই থাকে। এটা আমাকে এক ধরনের মানসিক সমর্থন জোগানো। এটা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আচরণবিধির লঙ্ঘন মনে করছেন? যদি মনে করেন, তাহলে কোন ধারার লঙ্ঘন?’
নির্বাচন কমিশনার আরো বলেন, ‘উনি (প্রধানমন্ত্রী) তো সরকারে আছেন। সংবিধানে উনাকে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত রাখা হলেও অধিষ্ঠিত নন। ওই ধারার জন্য প্রযোজ্য হবে। উনি তো উনার বাসভবন থেকে যেতে পারবেন না। কারো সঙ্গে যদি উনি দেখা করতে চান, তাহলে কোথায় দেখা করবেন? রাস্তার মধ্যে এসে?’
আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় তো আছে, এমন প্রশ্নের জবাবে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভাই, বাসভবন ওটা। গুলাইয়েন না কিন্তু। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়, আমি কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখা করব। তাঁরা আসছেন আমার বাসাতে, আমাকে বাসাতেই দেখা করতে হবে।’
তাহলে গণভবন, বঙ্গভবন ব্যবহার করে প্রচার চালানো যাবে কি না—এর উত্তরে এই কমিশনার বলেন, ‘প্রচার চালালে আচরণবিধি লঙ্ঘন হবে, তখন আমরা ব্যবস্থা নেব। তারা (বিএনপি) বলুক, প্রচার চালাচ্ছে।’
রফিকুল ইসলাম আরো বলেন, ‘তাঁরা আসছেন, দেখা করেছেন, সমর্থন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁরা নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। আমি যতটুকু আচরণবিধিমালা বুঝি, তাতে মনে হচ্ছে না এটা আচরণবিধির লঙ্ঘন।’