খালেদা জিয়ার আপিলের সময় কে কী বললেন
কারাবন্দি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৭ আসনে মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়া হয়েছিল। দুটি মামলায় তিনি দণ্ডিত হওয়ায় রিটার্নিং কর্মকর্তারা তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল বলে ঘোষণা করেন। এরপর গত ৫ ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তাঁর পক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আপিল আবেদন করেন।
আজ দুপুরে নির্বাচন কমিশনে খালেদা জিয়ার তিনটি আপিলের শুনানি একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। এ সময় সেখানে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ অন্য আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
শুনানিতে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেন, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া তিনটি আসন থেকে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তারা ১২/১ (ঘ) অনুসারে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন। এই ধারা নির্বাচনী অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত।
আইনজীবীরা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের কাছে জানতে চান, খালেদা জিয়া বর্তমানে কারাগারে আছেন। তিনি কীভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেন বা নির্বাচনী অপরাধ করলেন? আর এই কারণে কীভাবে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়?
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেন, খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিলের কারণ হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তারা যা দেখিয়েছেন, সে অনুসারে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল সঠিক হয়নি। সে কারণে কমিশনের কাছে আপিল করা হয়েছে। তাঁরা বলেন, ‘প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রয়েছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার। সেই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও, আইনগতভাবে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অধিকার রাখেন। যে আদেশ রিটার্নিং কর্মকর্তারা দিয়েছেন, আইনের দৃষ্টিতে তা বৈধ নয়। আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে যথাযথ আদেশ দেবে। এবং রিটার্নিং কর্মকর্তারা যে আদেশ দিয়েছেন, কমিশন তা বাতিল করবে। আমরা আশা করি, আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নেবেন।’
২০ মিনিটের শুনানিতে নির্বাচন কমিশন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় তা স্থগিত রাখা হয়। কমিশন জানায়, বিকেল ৫টায় খালেদা জিয়ার আবেদনের ওপর আবার শুনানি হবে।
শুনানির অংশ হিসেবে বিকেলে আবার খালেদা জিয়ার আপিলের বিষয়টি আসে। এ সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবীরা এ জে মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবেদীন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন যুক্তিতর্কে অংশ নেন।
তাঁরা আইনের ধারা উল্লেখ করে খালেদা জিয়ার পক্ষে রায় দাবি করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাপরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য রিয়াজুল কবির কাউসার খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বিপক্ষে মত তুলে ধরেন।
এ সময় কোনো পক্ষের আইনজীবী না হওয়ার পরও ইউসুফ হোসেনের বক্তব্যের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এ জে মোহাম্মদ আলী। তাঁকে উদ্দেশ করে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘হু আর ইউ?’
ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ছাড়াও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের বেশ কয়েকজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
এই ঘটনার পরপরই নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক যথাক্রমে ফেনী-১, বগুড়া ৭ ও ৮ এ খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে যে আপিল দায়ের করা হয়েছে তা আইনগত বিশ্লেষণ করে আমার রায় এই আপিল মঞ্জুরের পক্ষে। আমি এই আপিল মঞ্জুর করলাম।
মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যের পরপরই বিএনপির আইনজীবীরা উল্লাস করে নির্বাচন কমিশনের কোর্ট রুমের পেছনের দিকে চলে যাওয়া শুরু করেন। অপরদিকে আওয়ামী আইনজীবীরা এর বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন।
এ সময় নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আপনারা ঠান্ডা হয়ে বসেন। এই রায় পূর্ণাঙ্গ নয়, এটি মাত্র একজনের রায়।
তখন উত্তপ্ত আদালত কক্ষেই কমিশনার রফিকুল ইসলাম তাঁর রায় ঘোষণা শুরু করেন। তিনি বলেন, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দণ্ডপ্রাপ্তরা নির্বাচন করতে পারেন না। এ কারণে খালেদা জিয়ার আপিল নামঞ্জুর করা হলো।
এরপর কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরীও একই রায় দেন।
কমিশনার কবিতা খানমও এই দুই কমিশনারের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে নৈতিক স্খখল জনিতকারণে দণ্ডিত হয়েছেন এবং তিনি (খালেদা জিয়া) এখনো কারাগারে আছেন। তাঁর দণ্ড স্থগিত হয়নি। আমরা বলতে চাই তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় এবং রিটার্নিং অফিসাররা যে আদেশ দিযেছেন, তার স্পিরিট বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী আপিল না মঞ্জুর করছি।
এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেন, আমি আমার কমিশনার রফিকুল ইসলাম, শাহাদাত হোসেন ও কবিতা খানম- এই তিনজনের পক্ষে রায় দিলাম। এই আপিল আবেদন মঞ্জুর হয়নি।
পরে ইসি সচিব বলেন, ৪-১ ভোটে এই আপিল নামঞ্জুর হলো।
গত বৃহস্পতিবার থেকে ইসিতে আপিল শুনানি শুরু হয়। এর মধ্যে প্রথম দিন ১৬০টি আবেদনের ওপর শুনানি করে ৮০ জনের প্রার্থিতাকে বৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আর গতকাল শুক্রবার ১৫০টি আবেদনের ওপর শুনানি হয়। এর মধ্যে ৭৮ জন তাদের প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। পাশাপাশি এদিন ৬৫ জনের প্রার্থিতা বাতিল এবং সাতজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখে নির্বাচন কমিশন। দুদিনে মোট ১৫৮ জন তাদের মনোনয়ন ফিরে পান। এতে ভোটের মাঠে তাদের লড়াইয়ের আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকল না।
মনোনয়নপত্র বাছাইকালে দুই হাজার ২৭৯টি মনোনয়নপত্র বৈধ ও ৭৮৬টি অবৈধ বলে ঘোষণা করেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এগুলোর মধ্যে বিএনপির ১৪১টি, আওয়ামী লীগের তিনটি এবং জাতীয় পার্টির ৩৮টি মনোনয়নপত্র রয়েছে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে ৩৮৪টি। এর মধ্যে আপিলের আবেদন এসেছে ৫৪৩টি।
৩৯টি দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে এবার ৩০০ সংসদীয় আসনে তিন হাজার ৬৫টি মনোনয়নপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে দলীয় মনোনয়নপত্র জমা পড়ে মোট দুই হাজার ৫৬৭টি, আর স্বতন্ত্র ছিল ৪৯৮টি।
আগামী ৯ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময়। ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ। আর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ৩০ ডিসেম্বর।