শহরের নতুন অতিথি পাতি সরালি
কুয়াশা মোড়ানো শীতের সকাল। তখনো শুরু হয়নি যান্ত্রিক কোলাহল। হঠাৎ পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর হয়ে উঠল চারপাশ। পাখিগুলোর নাম পাতি সরালি। পাবনা শহরের নতুন অতিথি এরা। এদের ছোট সরালি বা গেছো হাঁস নামেও ডাকা হয়।
আজ বৃহস্পতিবার এমন দৃশ্যের দেখা মিলল পৌর শহরের চকছাতিয়ানী, ছাতিয়ানী, পৌলানপুরসহ ১২ নম্বর ওয়ার্ডের আশপাশে।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান এ এ এইচ এম মঞ্জুরুল মামুন বলেন, ‘শীতকালে সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের অতিথি পাখি আসে। শীত চলে গেলে আবার এরা চলে যায়। তবে শীতকালে বাংলাদেশে যেসব পাখি দেখা যায়, তার মধ্যে এই পাতি সরালি অন্যতম। এটি ছোট সরালি বা গেছো হাঁস নামেও পরিচিত।’
‘এর বৈজ্ঞানিক নাম ড্রেনড্রোসিগনা সাভানিকা। এটি মূলত দেশি বা আবাসিক পাখি। তবে শীতকালে লোকালয়ে দলবদ্ধ হয়ে থাকায় অনেকেই একে পরিযায়ী পাখি ভেবে ভুল করেন। দেশি পাখি হলেও শীতকালে ভারত, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে উড়ে এসে এ দেশে আবাস গড়ে তোলে এই পাখি।’
এ এ এইচ এম মঞ্জুরুল মামুন বলেন, ‘আগে পাবনা জেলা পরিবেষ্টিত চলনবিল, ডিকশির বিল, বরবিল, গাজনার বিল, পাতিবিল, ঘুঘুদহের বিল, গাংভাঙার বিল, আড়িয়াডাঙ্গি বিল, খলিসাদহ বিলসহ জেলার ২০/২২টি বিলে অতিথি পাখি আসত। তবে এখন আর অতিথি পাখিদের জন্য এসব বিল নিরাপদ নয়। তা ছাড়া এ বিলে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় পাখিদের আবাসস্থল নষ্ট হয়ে গেছে। পাখিদের খাবার শামুক-শেওলা নেই। তা ছাড়া শহরের চেয়ে গ্রামে শিকারিরা নিরাপদে পাখি শিকার করতে পারে। তাই এসব পাখি এখন গ্রাম ছেড়ে শহরে আসছে।’
পাখি বিশেষজ্ঞরা জানান, পাতি সরালি নিশাচর স্বভাবের আবাসিক পাখি। দিনে জলমগ্ন ধানক্ষেত ও বড় জলাশয়ের আশপাশে দলবদ্ধভাবে জলকেলি আর খুনসুটিতে ব্যস্ত থাকলেও রাতে খাবারের সন্ধানে চরে বেড়ায় এরা। এদের প্রধান খাবার পানিতে থাকা গুল্ম জলজ উদ্ভিদ, নতুন কুঁড়ি, শস্যদানা, ছোট মাছ, ব্যাঙ, শামুক, কেঁচো ইত্যাদি। পাখিটির মাথা, গলা ও বুক বাদামি, কালো পা এবং ঠোঁট ধূসর-কালচে রঙের। পিঠে হালকা বাদামির ওপর নকশা আঁকা ও লেজের তলা সাদা। পুরুষ ও স্ত্রী পাখি দেখতে একই রকম। প্রজনন মৌসুমসহ অন্য সময় এরা জুটি বেঁধে পৃথকভাবে দুর্গম বিল-হাওরে বসবাস করে। তাই শীত ছাড়া এদের একসঙ্গে বেশি দেখা যায় না। পাতি সরালির ওজন প্রায় ৫০০ গ্রাম, দৈর্ঘ্য ৪৫ সেন্টিমিটার। সাধারণত এদের ডানা ১৮ দশমিক ৭ সেন্টিমিটার, ঠোঁট চার সেন্টিমিটার এবং লেজ ৫ দশমিক ৪ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে।
পাখি দেখতে এসে কথা হয় এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা মুকুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকায় অতিথি পাখির সমাগম ঘটলেও পাবনার শহর এলাকায় এবারই প্রথম এদের বিচরণ দেখলাম। নগরের যান্ত্রিক শব্দের বদলে এখন সকালে ঘুম ভাঙে ওদের কোলাহলে। ওরা যেন নিরাপদে এখানে থাকতে পারে, তার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। পাখিশিকারি বা বাইরের কারো দ্বারা ওদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে।’
পাবনার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক এহসান আলী বিশ্বাস বলেন, ‘এই পাখি দেশি প্রজাতির হলেও পাবনার জন্য এরা অতিথি ও দেশীয় সম্পদ। পাখি শিকারের বিরুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রচার বৃদ্ধির পাশাপাশি আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে এই সম্পদ রক্ষা করতে হবে।’
এ ব্যাপারে সামাজিক বন বিভাগ পাবনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘শীতের এই সময়ে পাবনার বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর পরিমাণে অতিথিসহ দেশি পাখির বিচরণ ঘটে। এদের নিরাপত্তার জন্য আমরা রাজশাহী বন্যপ্রাণী বিভাগ ও পুলিশের সহায়তায় মাঝেমধ্যেই শিকারবিরোধী অভিযান পরিচালনা করি। তবে লোকবলের অভাবে এটা সব সময় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।’
পাবনার পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অতিথি পাখি শিকারিদের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর অবস্থান। অতিথি পাখি যাতে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনে সিভিল ড্রেসে পুলিশ মোতায়েন থাকবে।’