‘বিরোধী দল শুধু পার্লামেন্টের ভেতরে নয় বাইরেও হয়’
কারাবন্দি বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘বিরোধী দল শুধু পার্লামেন্টের ভেতরেই হয় না,পার্লামেন্টের বাইরেও বিরোধী দল হয়। যারা জনগণের কথা বলে,মানুষের অধিকারের কথা বলে তারাই বিরোধী দল।’
আজ বুধবার দুপুরে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থিত ঢাকার ৯ নং বিশেষ জজ শেখ হাফিজুর রহমানের আদালতে নাইকো দুর্নীতি মামলার শুনানিকালে এসব কথা বলেন খালেদা জিয়া।
এ সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ,জমির উদ্দিন সরকার, জয়নুল আবেদীন, এজে মোহাম্মদ আলী মাসুদ আহমেদ তালুকদার উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন মোশাররফ হোসেন কাজল।
পুলিশের নিরাপত্তা বেস্টনির মাধ্যমে সকাল ১১টা ৩৫ মিনিটে খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করা হয়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন গৃহকর্মী ফাতেমা। আদালত কক্ষে প্রবেশ করেই খালেদা জিয়া তাঁর আইনজীবীকে জিজ্ঞাসা করেন বোরহান সাহেব কেমন আছেন? এ সময় আইনজীবীরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সালাম বিনিময় করেন।
এরপর দুপুর ১১টা ৪০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বিএনপির চেয়ারপারসন হুইল চেয়ারে বসা ছিলেন।
এ সময় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ শুনানি শুরু করেন। শুরুতেই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত এ মামলায় আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে; আমি মন্ত্রী হিসেবে হিসেবে মতামত দিয়েছি। কিন্তু মামলার অভিযোগপত্র বা এফআইআরেতো এসব মতামত কিছুই নেই। আমি তাঁর কোনো নথি পাইনি। মামলার ডকুমেন্ট এবং চিজার লিস্টে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই।’
এ সময় বিচারক বলেন, ‘ক্রিমিনাল মামলায় কোনো ডকুমেন্ট না থাকলে এর সুবিধা আসামি পেয়ে থাকেন। আর আপনিতো সার্টিফায়েড কপি পাওয়ার জন্য আবেদনও করেননি। আপনি চাইলেতো পাবেন।’
এ সময় মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আজকেই আবেদন করেছি। মাইলর্ড আমাকে একটু দেওয়ার জন্য বলেন।’ এরপর দুদকের আইনজীবী মোশররফ হোসেন কাজলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শুরু হয়।
এ সময় মওদুদ আহমদ বলেন, ‘নাইকো কোম্পানির সাথে চুক্তি এবং সকল কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় ১৯৯৭-১৯৯৯ সালের মধ্যে। ওই সময় ক্ষমতায় ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। এবং জ্বালানি উপদেষ্টাও ছিলেন বর্তমান সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী। সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করাই ছিলো আমার সরকারের কাজ। পৃথিবীর সকল দেশে এবং আমাদের দেশের প্রতিটি সরকারও পূর্বের আমলের চুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। কাজেই নাইকো চুক্তির ঘটনায় কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে প্রথমে যারা চুক্তি করেছে তাঁরা অপরাধ করেছে। এখানে পরবর্তী সরকারের কোনো অপরাধ নেই।’
মওদুদ আহমদ আরো বলেন, ‘কেননা ১৯৯৮ সালে সর্বনিম্ন স্কোর নিয়ে কানাডিয়ান কোম্পানির আবেদন বাতিল হয়ে যায়। এরপরও তাঁরা বিভিন্ন অজুহাতে আবেদন করতে থাকে। ২৮ জুন ১৯৯৮ সালে আরো একটি পত্র পাঠিয়ে সিলেটের ছাতক এলাকায় গ্যাস উত্তোলনের জন্য একটি প্রস্তাব পাঠায়। তৎকালীন জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই এলাহীর পরামর্শে পরবর্তীতে তাঁরা চুক্তি করে। এখন ভুল করলে তারা করেছে। এখানে আমাদের দোষ কি? যদিও তৌফিক-ই-এলাহী আমার বায়রা ভাই। কিন্তু আমরাতো এখন বিরোধী দলে। এমনিতে বিপদে আছি।’ এ সময় পাশে অপর আইনজীবী বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘বিরোধী দলেও নেই।’ এ সময় হেসে উঠে মওদুদ আহমেদ বলেন, ‘ও হ্যাঁ তাইতো। বিরোধী দলেও নেই।’
এ সময় আদালতে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিরোধী দল শুধু পার্লামেন্টের ভেতরেই হয় না,পার্লামেন্টের বাইরেও বিরোধী দল হয়। যারা জনগণের কথা বলে,মানুষের অধিকারের কথা বলে তারাই বিরোধী দল।’
এরপর আজকের মতো শুনানি শেষ করার জন্য সময় চেয়ে মওদুদ আহমদ বলেন,‘আজকে আমার হাইকোর্টে ৩৬৫ জন আসামির আগাম জামিন আছে। আমাকে ওইখানে যেতে হবে। আজকের মতো সময় দেওয়া হোক।’
এরপর আদালত পরবর্তী অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য ২১ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন। এ সময় আইনজীবী মাসুদ আহেমেদ তালুকদার আদালতকে বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত এ মুহূর্তে ম্যাডাম খালেদা জিয়া অনেক অসুস্থ। আগামী ১৬ জানুয়ারি অপর একটি মামলার তারিখ রয়েছে। এ মামলার অন্যতম আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া খুবই অসুস্থ। তাঁর কাছে এ মামলার অনেক নথি রয়ে গেছে। তিনি কথা বলতে পারছেন না। তাই সময় পিছিয়ে দেওয়া হোক।’
এ সময় বিচারক বলেন, ‘আমরা সানাউল্লাহ মিয়ার খোঁজ খবর নিয়েছি। তিনি বাসায় আছেন।’ এরপর ২১ জানুয়ারি দিন ধার্য বহাল রাখেন।
এরপর দুপুর পৌনে দুইটার দিকে খালেদা জিয়াকে হুইল চেয়ারে করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে সকালে আদালতের কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগে আদালতের উপস্থিত হন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। খালেদা জিয়াকে আদালতে নিয়ে আসার পরে বেশ কিছুক্ষণ মির্জা ফখরুল ইসলাম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলাপ করেন। এরপর আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগে তিনি (ফখরুল) আদালত থেকে বের হয়ে যান।
এই কারাগারেই দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বন্দী রয়েছেন তিনি। আজ মামলাটির অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় কানাডার কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিপুল আর্থিক ক্ষতিসাধন ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম নাইকো মামলাটি করেন।
পরে ২০০৮ সালের ৫ মে এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহকারী পরিচালক এস এম সাহেদুর রহমান।
অভিযোগপত্রে প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়।
এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ,সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন,সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী,জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম,সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন,বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক,সাবেক সচিব মো.শফিউর রহমান,ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুন,ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া ও নাইকোর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ।