আমি দেখতে পাই না ঠিকই, কিন্তু অন্ধ নই : আইনজীবী শশী
পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই চোখে দেখেন না, এরপর আবার দুটি কিডনি অকেজো। সপ্তাহে দুটি, কখনো কখনো তিনটি ডায়ালাইসিস নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে তাঁর জীবন। এত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও তিনি পাস করেছেন আইন বিদ্যা। এখন চালিয়ে যাচ্ছেন অন্য দশটা আইনজীবীর মতোই আইন পেশা।
মারজিয়া রব্বানী শশী, যিনি দৃঢ় মনোবল, কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে ধাপে ধাপে সাফল্যের পথে এগুচ্ছেন। সবার ভালোবাসায় পৌঁছাতে চান কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।
রাজধানীর সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি (অর্নাস) পাস করেন শশী। স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন তিনি জানতে পারেন, তাঁর দুটি কিডনিতে ড্যামেজ ধরা পড়েছে।
এরপর প্রথমে ভারতের ভেলোরের সিএমসি হাসপাতালে চিকিৎসক দেখান শশী। তাঁর দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানান সেখানকার চিকিৎসকরা। এ সময় তাঁর কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা বলেন তাঁরা।
এরপর বাংলাদেশে নিয়ে এলে ২০১৫ সালে ঢাকার চিকিৎসকরা শশীকে ডায়ালাইসিস দেওয়া শুরু করেন।
ফরিদপুরের আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম রব্বানী বাবু মৃধা ও আফরোজা রব্বানীর তিন মেয়ের মধ্যে মারজিয়া রব্বানী শশী দ্বিতীয়। শশীর বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছোট বোন চীনের সুজো মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়েন।
পড়াশোনায় শশীর মা ও ছোট বোন তাবিদা রব্বানী তাঁকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। শশীর মা বই পড়তেন, আর এই পড়া শুনে তিনি পড়া বুঝতেন। অন্যদিকে শশীর ছোট বোন পরীক্ষার হলে তাঁর রাইটার হিসেবে কাজ করতেন।
প্রচন্ড মেধাশক্তির শশী যা একবার শোনেন তা একইভাবে মনে রাখতে এবং বলতে পারেন বলে জানান তাঁর শিক্ষক ও বাবা-মা।
শশী বার কাউন্সিল পরীক্ষায় পাস করে ফরিদপুর জজ কোর্টে বাবার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন আইন পেশা। এদিকে মেয়ের পেছনে প্রতি মাসে এতো টাকা ব্যয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে বাবা-মাকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শশীর কথা শুনে তাঁর বাবাকে দুই লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সে টাকাও খরচ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন মেয়ের একটি কিডনি জোগার করার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর বাবা, কিন্তু পাচ্ছেন না। মেয়েকে বাঁচাতে হলে একটি কিডনি খুবই দরকার বলে মাঝেমধ্যেই বিভিন্নজনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন তাঁর বাবা-মা। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সাহায্যও চেয়েছেন।
শশীর বাবা অ্যাডভোকেট গোলাম রব্বানী বাবু মৃধা বলেন, ‘শশী আমাদের গর্বের সন্তান। তবে এখন শারীরিক কারণে তাঁর প্রচুর সমস্যা হচ্ছে। একটি কিডনি যদি পেতাম, তাহলে হয়তো তাঁকে স্বাভাবিক একটি জীবন উপহার দিতে পারতাম। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে আমার মেয়ের কথা শুনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুই লাখ টাকা দেন। আমরা পুরো পরিবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে চির কৃতজ্ঞ।’
শশীর মা আফরোজা রব্বানী বলেন, ‘আমার মেয়েটি এতো মেধাবী, যা বলার মতো নয়। ও একবার যা শোনে, তাই বলতে পারে। আমরা ওকে কোনো কিছুতে অপূর্ণ রাখিনি। কিন্তু বলে কি হবে, ওর এতো কষ্ট, যা বলার নয়। মাসে ৯ থেকে ১০টি ডায়ালাইসিস নিতে হয় তাঁকে। তারপর আবার কোর্টে গিয়ে প্র্যাকটিস করে। কত আশা ওর, সেই আশার কি হবে কে জানে?’
ফরিদপুর জজকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও শশীর সহকর্মী অ্যাডভোকেট এম এ ছামাদ বলেন, ‘আমাদের কোর্টের খুব মেধাবী মেয়ে শশী। আমরা তাঁর মতো একজন ভালো সহকর্মী পেয়ে গর্বিত। তাঁর উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। তবে অসুখের কারণে ওর জীবনে অনেক সমস্যা হচ্ছে। আমরা সবাই চাই, ও ভালো হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসুক।’
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও শশীর চিকিৎসক ডা. স্বপন কুমার মন্ডল বলেন, ‘এখন শশীর সামনে একটাই পথ আছে, সেটি হলো একটি কিডনি ওর দেহে প্রতিস্থাপন করা। এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তবে ডায়ালাইসিস দিয়ে রাখা যাবে। তবে তা করলে একটা সময় পর্যন্ত গিয়ে সবাইকেই থামতে হয়। এখন একটি কিডনি পেলে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে।’
নিজের ব্যাপারে মার্জিয়া রব্বানী শশী বলেন, ‘আগে মন থেকে অনেক কষ্ট পেতাম, কোথায় যাবো, কী করবো। তারপর বাবার সঙ্গে ঢাকায় আসি, অনেক ভাবার পর আইন বিদ্যায় পড়াশোনা করি। শেষ পর্যন্ত আমি আমার সাফল্যে পৌঁছাতে পেরেছি। আমার শেষ ইচ্ছা, প্রতিষ্ঠিত একজন আইনজীবী হওয়া।’ তিনি বলেন, ‘আমি দেখতে না ঠিকই, কিন্তু আমি অন্ধ নই।’
এদিকে সহকর্মী ও পরিবারের আশা শশী, আরো অনেকদিন তাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তাঁর চোখ ও কিডনি ভালো হবে, চালিয়ে যাবেন আইন পেশা।