ইসি দাবি করলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়ে যায় না
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করলেই যে তা সুষ্ঠু হয়ে যাবে, এমন কোনো কথা নেই। জনতার চোখ বলে একটা কথা আছে। আমাদের ও আপনাদের সবার কর্মকাণ্ড জনতার চোখে পরীক্ষিত হবে।’
আজ বৃহস্পতিবার সকালে আগারগাঁওয়ের ইটিআই ভবনে ঢাকা উত্তর সিটি মেয়রের শূন্য পদে স্থগিত নির্বাচন, উত্তর ও দক্ষিণ সিটির নবগঠিত ৩৬টি ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে স্থগিত নির্বাচন এবং উত্তর সিটির ৯ ও ২১ নম্বর সাধরণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের শূন্য পদে নির্বাচন উপলক্ষে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন নির্বাচন কমিশনার।
মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আমি কিছুটা পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি। এর অভিজ্ঞতা কিঞ্চিৎ আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি, যা আপনাদের সহায়ক হতে পারে। আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মূলত দুই প্রধান শক্তির ওপর নির্ভরশীল। একদিকে নির্বাচন কর্মকর্তা বা নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা; অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমি এখন পর্যন্ত যেসব কাগজপত্র দেখেছি, তাতে রিটার্নিং কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষক পর্যন্ত সবার প্রতিবেদনে দুটি শব্দ অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে। একটি শব্দ হচ্ছে সন্তোষজনক এবং অন্য শব্দটি হচ্ছে স্বাভাবিক। তার মানে কি আমাদের নির্বাচন খুবই সন্তোষজনক হয়েছে? এ ক্ষেত্রে পাবলিক পারসেপশন কী, তা নিজেদের কাছেই জিজ্ঞেস করতে হবে।’
‘নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করার বিষয়ে আমি সব সময় গুরুত্বারোপ করেছি। এই গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করলেই যে তা সুষ্ঠু হয়ে যাবে, এমন কোনো কথা নেই। জনতার চোখ বলে একটা কথা আছে। আমাদের ও আপনাদের সবার কর্মকাণ্ড জনতার চোখে পরীক্ষিত হবে। সুতরাং যথার্থ একটি গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার জন্য আমাদের সবাইকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।’
নিজের অভিজ্ঞতার বিষয়ে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমি ভারতে ছিলাম। সেখানে একটি পত্রিকায় নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা নিয়ে লেখা একটি আর্টিকেল পড়ি। তাতে দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করা ছিল। এতে লক্ষ করা যায়, নির্বাচনী দায়িত্বে যাঁরা নিয়োজিত, সেই নির্বাচনী কর্মকর্তারা নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে অনড় ছিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনিয়ম সম্পর্কে তাঁরা কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে পিছপা হননি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত যে অনেক বৈপরীত্য সত্ত্বেও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা সমুন্নত রেখেছে। তার পেছনে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের অবদান কম নয়।’
‘নির্বাচন কমিশনে আমার দুই বছরের অভিজ্ঞতা বলে, বিভিন্ন প্রতিবেদনে বিশেষত, নিজস্ব পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদনে সাধারণত কোনো নেতিবাচক বিষয় লিপিবদ্ধ করার বিষয়ে আমরা দ্বিধান্বিত। সবাই যেন কাগজেপত্রে গা বাঁচিয়ে চলতে চান। যদি কেউ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমার কথার বিরোধিতা করতে পারেন, তাহলে আমি খুশি হবো। আমি মনে করি, নির্বাচনে প্রকৃত চিত্রটি সবার প্রতিবেদনে উঠে আসা উচিত।’
মাহবুব তালুকদার আরো বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সম্মান ও মর্যাদা—এর কার্যক্রমের ওপরে নির্ভর করে। এর সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়সহ মাঠপর্যায়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সব প্রার্থীর প্রতি সমআচরণের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানের সম্মান, মর্যাদা ও পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর।’
আসন্ন সিটি নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাকে আমি নাতিশীতোষ্ণ নির্বাচন বলব। কারণ এই নির্বাচনের মেয়র পদে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথা ছিল, যে উত্তাপ ও উষ্ণতা থাকার কথা ছিল, এখন পর্যন্ত অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তা হবে না। কেবল কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিছুটা উষ্ণতা আশা করা যায়। আসন্ন নির্বাচনের শৈত্যপ্রবাহ তাতে কেটে যাবে বলে আমরা মনে করতে পারি।’
মাহবুব তালুকদার আরো বলেন, ‘বিগত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় প্রধান বিরোধী প্রার্থী সমান সুযোগ না থাকার কথা বলে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। যদিও সত্যিকার অর্থে এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে প্রধান বিরোধী দলের কোনো প্রার্থী নেই। তবুও নির্বাচনে অনিয়মের কথা বলে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘটনা যে ঘটবে না, তা বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে একটি শুদ্ধ, আইনানুগ নির্বাচন করা। যাতে নির্বাচনকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ না পান।’
নির্বাচন কমিশনার আরো বলেন, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর ঢাকার এই নির্বাচনের দিকে দেশবাসী, এমনকি উন্নয়ন সহযোগীরা তাকিয়ে আছেন। আমরা কী ধরনের নির্বাচন উপহার দিই, তা দেখার জন্য। নির্বাচনকালে আমরা কোনো চাপ, কোনো ভয়ভীতি বা প্রলোভনের কাছে নতিস্বীকার করব না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,/ তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে।’
ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা, নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।