বিশ্ব ইজতেমা শুরু হচ্ছে শুক্রবার, দুই মুসুল্লির মৃত্যু
গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে কাল শুক্রবার সকাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ইজতেমা শুরু হচ্ছে। তবে এর আগেই বুধবার রাত থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ইজতেমা ময়দানে জড়ো হয়েছেন মুসুল্লিরা।
এদিকে বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে আসা দুই মুসুল্লির মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. জব্বর আলী ওরফে রাজ্জাক (৪২) ও নাটেরের মোহাম্মদ আলী (৫৫)।
ইজতেমার মাজলেহাল জামাতের জিম্মাদার মো. আদম আলী জানান, বুধবার ভোর রাত ৩টার দিকে ও বৃহস্পতিবার বেলা ১টার দিকে তাঁরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার ভোরে ও দুপুরে ইজতেমা ময়দানে জানাজা শেষে তাঁদের লাশ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে।
এবারের বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা জোবায়ের ও মাওলানা সাদ অনুসারীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও সংঘর্ষ নিয়ে যে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার সমঝোতা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে উভয় অনুসারীদের পৃথক ব্যবস্থাপনায় দুদিন করে টানা চারদিন অনুষ্ঠিত হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা। প্রথম দুই দিনের ইজতেমায় মাওলানা জোবায়ের অনুসারীরা এবং পরবর্তী দুই দিন মাওলানা সাদ অনুসারীরা অংশ নেবে। এ উপলক্ষে ইজতেমা ময়দানের প্রায় এক বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল। ইজতেমা মাঠ এখন পুরোপুরি প্রস্তুত বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের জন্য। ইজতেমা মাঠের প্রস্তুতি কাজ শেষ হওয়ার পর স্থানীয় সাংসদ, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বৃহস্পতিবার মুরুব্বিদের নিয়ে ইজতেমা মাঠ পরিদর্শন করেন।
প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, ইজতেমা অনুষ্ঠানের জন্য টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান এখন পুরোপুরি প্রস্তুত।
একদিন আগেই শুরু
গতকাল বুধবার রাত থেকে দলে দলে মুসুল্লিরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইজতেমা ময়দানে আসতে শুরু করেন। শুক্রবার সকাল থেকে আম বয়ানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার বাদ আছর থেকে জোবায়ের অনুসারীদের বিশ্ব ইজতেমার বয়ান শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের মাওলানা ওবায়দুল্লাহ খুরশিদ এ বয়ান করেন। বয়ান তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মো. জাকির হোসেন। বাদ মাগরিব শুরু হয় ইজতেমার আম বয়ান। আম বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আহমেদ লাট। আম বয়ান তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা ওমর ফারুক। প্রতি বছর আম বয়ান দিয়েই বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়। শনিবার দুপুরের আগে সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে যে কোনো সময় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এ পক্ষের বিশ্ব ইজতেমা। পরে শনিবার রাত ১২টার মধ্যে তারা ইজতেমাস্থল ত্যাগ করবে।
পরদিন রোববার ১৭ ফেব্রুয়ারি বাদ ফজর শুরু হবে সাদ অনুসারীদের ইজতেমার কার্যক্রম। ১৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমা শেষ হবে। এবার ইজতেমায় থাকছে না কোনো ধাপ বা পর্ব।
দুই পন্থীদের মধ্যে বিবাদ থাকলেও এক সঙ্গে তাবলিগ অনুসারী, এলাকাবাসী ও প্রশাসনসহ সর্বস্তরের মানুষের দাবি, এবারের বিবদমান বিশ্ব ইজতেমা যেন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়।
বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরুব্বি ইঞ্জিনিয়ার মেজবাহ উদ্দিন ও মো. মাহফুজুর রহমান জানান, ১৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার শুরু হবে তাবলিগ জামায়াত আয়োজিত বিশ্ব ইজতেমা। তবে বৃহস্পতিবার বাদ আছর পাকিস্তানের মাওলানা ওবায়দুল্লাহ খুরশিদ মাঠ জমানোর বয়ান শুরু করেন। আর তা তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মো. জাকির হোসেন। বাদ মাগরিব আম বয়ানের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রাথমিক কর্যক্রম শুরু হয়েছে। ভারতের মাওলানা আহম্মদ লাট ওই বয়ান শুরু করেন। আম বয়ান তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা ওমর ফারুক। এবার বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে দেশ-বিদেশের কয়েক লাখ মুসল্লি এরই মধ্যে ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন। এ ছাড়াও মুসুল্লিদের আগমন অব্যাহত রয়েছে।
এবার বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন দেশের ৬৪ জেলার মুসুল্লি। তারা ময়দানের তাবুর নিচে ৫০টি খিত্তায় বসে ইজতেমার মুরুব্বিদের বয়ান শুনবেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ইজতেমা ময়দানে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ বিতরণ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ধর্ম সচিব আনিসুর রহমান, গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ওয়াইএম বেলালুর রহমান। ইজতেমা ময়দানে মুসুল্লিদের স্বাস্থ্য সেবায় রয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হামদর্দ, ইবনে সিনা, র্যাব, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, যমুনা ব্যাংক, ইসলামিক মিশনসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থা।
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, তাবলিগ জামাতের দুইপক্ষের মুরুব্বিদের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল তা নিরসন করে একটানা চার দিনের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানে সক্ষম হয়েছি। তিনি আরো বলেন, তাবলিগ জামাত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমায় ধর্মীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টির জন্য এ ইজতেমার আয়োজন করে থাকেন তাবলিগের মুরুব্বিরা। তাবলিগ জামাত বিশ্বে একটা বড় ডিসিপ্লিনের উদারণ। এটাকে আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না।
যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, বিশ্ব ইজতেমার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, টয়লেট নির্মাণসহ সব কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন রয়েছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হূমায়ূন কবীর জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরের মধ্যে কয়েক লাখ মুসুল্লি ইজতেমা ময়দানে এসে পৌঁছেছেন। এ ছাড়া মুসুল্লিদের আগমন অব্যাহত রয়েছে। এখানে বিভিন্ন দেশের মুসুল্লিরাও রয়েছে। মুসুল্লিদের সুবিধার্থে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে এবারের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হোক এটাই সবার প্রত্যাশা।
বিশ্ব ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা গেছে, টঙ্গীর তুরাগ তীরে ১৬০ একর বিস্তৃত বিশ্ব ইজতেমা ময়দান প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। দেশ-বিদেশের মুসুল্লিরা অবস্থান নিয়েছেন তাদের নির্ধারিত তাঁবুর নিচে। তারা জিগির-আজগার এবং আল্লাহর ইবাদতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। একদিকে রান্নাবান্না, কাপড় কাচা ও গোসল করাসহ দৈনন্দিন কাজও সেরে নিচ্ছেন। ময়দানে আশপাশে বসেছে হরেক রকমের দোকান। এর মধ্যে অনেকেই সেরে নিচ্ছে প্রয়োজনীয় কেনাকাটাও। এসব মিলিয়েই টঙ্গীর তুরাগ তীরে যেন মুসুল্লিদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। বৃদ্ধ, যুবক, কিশোর ও তরুণসহ সব বয়সের মুসুল্লিরা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে ও টুপি মাথায় ইসলামের এ মেলায় শরিক হয়েছেন।
ইজতেমা ময়দানে যতটুকু চোখ যায়, শুধু দেখা মিলে টুপি-পাঞ্জাবী পরা মুসুল্লিদের। মাথার ওপর চটের তাবু, নিচে সবুজ ঘাস। এর মধ্যে বিছানাপত্র বিছিয়ে রাত্রী যাপনসহ ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল হয়ে পড়েছেন ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিরা।
গত জানুয়ারি মাসে ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিলে সংঘর্ষের পর ইজতেমা অনুষ্ঠান স্থগিত হয়ে যায়। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় দুই মুসুল্লি নিহত ও পাঁচ শতাধিক মুসুল্লি আহত হন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহে স্থানীয় সাংসদ, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এবং ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে দুইপক্ষকে এক সঙ্গে এনে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের কার্যক্রম শুরু করেন।
বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বিআরটিসি মুসুল্লিদের আনা-নেওয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ইজতেমা মাঠের সংস্কার কাজ এবং সেবামূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করেছে। বিশ্ব ইজতেমার সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য ইজতেমা মাঠে পাঁচটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন, গাজীপুর জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, র্যাব, আনসার ও ভিডিপির কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রশাসনের ১৫টি ওয়াচ টাওয়ার, র্যাবের ১০টি ওয়াচ টাওয়ার, মুসুল্লিদের জন্য ৩৫০টি অস্থায়ী শৌচাগার নির্মাণ, ওজু, গোসল, পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ১৩টি গভীর নলকূপ থেকে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন ৩ কোটি ৫৪ লাখ গ্যালন সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া রয়েছে আকাশ ও নৌ-পথে পুলিশ, র্যাবের নিয়মিত টহল। নিরাপত্তা চাঁদরে ঘিরে ফেলা হয়েছে টঙ্গী শিল্পনগরী পুরো শহরটিকে।