‘সে হারালো কোথায় কোন দূর অজানায়’
‘আমি আর নিতে পারছি না। এটাও মেনে নিতে হবে!’ কথাগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন সামিনা চৌধুরী। কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর মৃত্যু মানতে পারছেন না তিনি।
গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ১টা ১২ মিনিটের দিকে শাহনাজ রহমতুল্লাহ শ্বাসকষ্টজনিত কারণে বারিধারার নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে সামিনা চৌধুরীসহ অনেকে শোক প্রকাশ করেছেন।
স্মৃতির ঝুড়ি খুলে আসিফ আকবর বলেন, ‘টরন্টো থেকে প্যান্সিলভ্যানিয়া , নিউজার্সি থেকে নিউইয়র্ক। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে হোটেলে আমার রুমে ঢুকেই দেখলাম আপা কোণের একটা সোফায় বসে আছেন। হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- আপা আপনি আমার রুমে? তিনি অসন্তুষ্ট আয়োজকদের ওপর। রাগ সব আমার উপরই ঝাড়লেন। আমি থাকতে আপার রুমে আরেকজনের সাথে রুম শেয়ারিং কেন? তাড়াতাড়ি আপার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা হলো।
আপার ৫০তম বিয়ে বার্ষিকীতে সর্বকনিষ্ঠ দাওয়াতি আমি। হাদী ভাই, রবিন ঘোষ স্যার থেকে শুরু করে দেশের মহারথীদের মিলনমেলা। আপা ঘুরে ফিরে আমাকেই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। আমাদের বিশেষ কিছু শো একসাথে ছিল। আপা আমাকে আসিফ নামেই ডাকতেন, তবে উচ্চারণটা ছিলো আলাদা। আপা অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। তবে এই লিখার শেষ নেই আপা। আগের প্রজন্মের শেষ বংশধর হিসেবে আপনার কাজ এবং সৃষ্টির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি ‘একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনারগাঁয়’। নামাজ পড়ার সময় এই মহান মৃত্যুকে স্বাগতম আপা। যান আপা ওখানে অনেক শান্তি অপেক্ষায়।বিদায় শাহনাজ রহমতুল্লাহ। আপনিই বাংলাদেশ আপা, মহান আল্লাহ আপনার আত্মাকে শান্তি দিন- আমিন।’
সংগীতশিল্পী দিনাত জাহান মুন্নী বলেন, “বেশ কয়েকবছর আগে টেলিভিশনে লাইভে তার একটি গান করেছিলাম আর তারই সুবাদে তিনি আমায় খুঁজে বের করে টেলিফোনে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার গান গাইবে?’এরপর মাঝেমাঝেই ফোন করতেন। বলতেন ‘বাসায় এসে কিছু গান তুলে নিস’। তুমি থেকে তুই আহা ভালোবাসা।কিছুদিন আগে ডলি ইকবাল আপার বাসায় আড্ডা। বরেণ্য সব শিল্পী ছিলেন শ্রদ্ধেয় ফেরদৌসী রহমান এবং তিনিও। তিনি গাইলেন খোলা জানালায় ডেকে নিলেন তপন চৌধুরী, শফিক তুহিন,আগুন ও আমাকে। দলবেঁধে গাইলাম তাঁরই সাথে। গত সপ্তাহে ফুয়াদ নাসের বাবু ভাই ফোন করে বললেন, ‘মুন্নী তুমি শাহনাজ রহমতুল্লাহ’র গান গাইবে তারই সামনে ২৬ মার্চে। ভাবলাম এটা যেন স্বপ্ন। বাবু ভাই দুদিন আগে ফোন দিয়ে বললেন, ‘প্র্যাকটিস করতে হবে শাহনাজ রহমতুল্লাহর বাসায় তারই সাথে।’”
শিল্পী মুন্নী আরো বলেন, “এরই মাঝে শাহনাজ আপা ফোন করে বললেন, ‘তুই শুক্রবার তোর হারমোনিয়াম এবং বকুলসহ চলে আসবি । শুক্রবার বকুলের কাজ থাকায় গেল না।একাই গেলাম সকাল সাড়ে ১১টায়। দরজা খুলেই বুকে জড়িয়ে রাখলেন প্রায় ৩০ সেকেন্ড। কী থেকে কী করবেন আহা। বেলের শরবত বানিয়ে রেখেছেন আমার জন্য। কত কথা। নিজের শোবার বালিশ এনে আমাকে হেলান দিয়ে বসালেন আমার হারমোনিয়ামে হাত দিয়েই বললেন ‘এত সুরেলা! আমারটাও একটু টিউন করিয়ে দিবি তুই।’ একের পর এক গান বাজিয়ে শেখাতে লাগলেন আমাকে। আমার জন্য ধুয়ে রাখা কত রকমের ফলের ট্রলি এরপর হাঁক ডাক। এই আমার বোন আমার সাথে খাবে। গাছের লাউ রাধো, কই মাছ , এটা সেটা কতকিছুর পদ।’ টেবিল সাজাও। কত কথা। এরই মাঝে ফুয়াদ নাসের বাবু ভাইও চলে এলেন। ২৬ মার্চ দেশ টিভিতে শাহনাজ রহমতুল্লাহর গান ‘ট্যাগোর ট্যারাস’ থেকে সরাসরি সম্প্রচার হবে। গাইবেন তিনি এবং আমিও। আসাদুজ্জামান নূর ভাই সরাসরি অনুষ্ঠানে থাকবেন সব সম্মানিত অতিথিসহ। একের পর এক গান তুললাম। তালিকা তৈরি। এরই মাঝে নামাজ- আমার জন্য তারই পাশে জায়নামাজ। নিয়ত বেঁধেছি। হঠাৎ উপলব্ধি করলাম টেবিল ফ্যান টেনে এনে আমার পেছনে চালিয়ে দিলেন যেন আমার গরম না লাগে। এরপর বাবু ভাই ও রহমতুল্লাহ ভাইসহ একত্রে দুপুরের খাবার খেলাম । আবারও প্র্যাকটিস। বিকেল সাড়ে ৪টায় ফেরার পালা। বললেন- তোর বাসায় যাব অনুষ্ঠানের পরই এরপর ঘরের কাপড় পরেই ছয়তলা থেকে নিচে নেমে এসে বিদায় দিলেন। বারবার বুকে জড়িয়ে ধরছিলেন। চালকের সিটে আমি তাই গেইট পর্যন্ত আমাকে নিরাপদে বিদায় জানালেন। গাড়ির ভেতর আমার মাথায় হাত রেখে বললেন সাবধানে যাস। এই শেষ বিদায়। এর ঠিক ৩১ ঘণ্টা পর আপনাকে চিরবিদায় জানাতে হবে- তা জানতাম না আপা। আপা, আপনার জীবনের শেষ দিনটায় আপনার সাথে থাকা স্মৃতিগুলো তো এখন আমাকে ভয়ংকর কষ্ট দিচ্ছে। আমি কিছুতেই এই সময়গুলো থেকে বের হতে পারছি না আপা।’
অভিনেত্রী ও নির্মাতা মেহের আফরোজ শাওন বলেন, “‘সে হারালো কোথায় কোন দূর অজানায়।’ বিদায় কিংবদন্তি। শ্রদ্ধা। ভালোবাসা।”
অন্যদিকে, সঙ্গীতশিল্পী সোমনুর মনির কোনাল বলেন, “‘স্মৃতি তাঁর আমাকে কাঁদায়।’শাহনাজ আপা, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। মহান আল্লাহতায়ালা আপনাকে জান্নাতের কোকিল করে দিন।আমিন। সবার কাছে কিংবদন্তির জন্য দোয়া চাইছি।”
শাহনাজ রহমতুল্লাহর কর্মজীবনের শুরু হয় ১৯৬৩ সালে ১১ বছর বয়সে ‘নতুন সুর’ নামক চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেওয়ার মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে প্রথম টেলিভিশনে তাঁর গাওয়া গান প্রচারিত হয়। তিনি গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আলাউদ্দিন আলী, খান আতাসহ বিখ্যাত সব সুরকারের সুরে গান গেয়েছেন। পাকিস্তানে থাকার সুবাদে করাচি টিভিসহ উর্দু ছবিতেও গান করেছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। গান শিখেছেন গজল সম্রাট মেহেদী হাসানের কাছে।
ব্যক্তিগত জীবনে শাহনাজ রহমতুল্লাহ ১৯৭৩ সালে আবুল বাশার রহমতুল্লাহর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। শাহনাজ রহমতুল্লাহর ভাই আনোয়ার পারভেজও একজন সুরকার ও সংগীত পরিচালক এবং আরেক ভাই জাফর ইকবাল ছিলেন জনপ্রিয় নায়ক ও গায়ক।