পোড়া শরীর নিয়েই চলে গেলেন নুসরাত
উন্নত চিকিৎসার জন্য আর সিঙ্গাপুর যাওয়া হলো না ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির (১৮)। আর কখনো মা-বাবার বুকে ফিরবেন না তিনি। ভাইদেরও আর কখনো ভাই বলে ডাকবেন না।
পোড়া শরীর নিয়ে টানা পাঁচদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হার মানলেন নুসরাত। আজ বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে নুসরাতকে মৃত ঘোষণা করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন নুসরাতের মৃত্যুর বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে রাত ৯টার দিকে নুসরাতের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। দ্রুত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ছুটে যান চিকিৎসকরা। এরপর সাড়ে ৯টার দিকে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
এর আগে গত ৮ এপ্রিল নুসরাত জাহানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা। কিন্তু এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর যাওয়ার মতো নুসরাতের শারীরিক অবস্থা না থাকায় সেখানকার চিকিৎসকরা ঢাকা মেডিকেলেই নুসরাতকে চিকিৎসার দেওয়ার পরামর্শ দেন। অবস্থার একটু উন্নতি হলে সিঙ্গাপুর আনতে বলেন। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী ঢাকাতেই নুসরাতের চিকিৎসায় সর্বাত্মক সেবা দেন বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা। কিন্তু সবাইকে কাঁদিয়ে তিনি চলে গেলেন চিরতরে।
এদিকে নুসরাতের মৃত্যুতে ঢাকা মেডিকেলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর স্বজনরা। এ সময় হাসপাতালে শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
নুসরাত এবার সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম (এইচএসসি সমমান) পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি সোনাগাজীর উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের মাওলানা এ কে এম মুসা মানিকের মেয়ে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। গত ৬ এপ্রিল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাদ্রাসা ভবনের ছাদে দুর্বৃত্তরা তাঁর গায়ে আগুন দেয়। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ফেনী সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।
পরিবারের অভিযোগ, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহানের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। নুসরাত বিষয়টি বাসায় জানালে তাঁদের মা সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সোনাগাজী থানা পুলিশ অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে।
এরপর মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে চাপ দেয় অধ্যক্ষের লোকজন। কিন্তু নুসরাত অপারগতা প্রকাশ করেন। এ অবস্থায় আলিম পরীক্ষা শুরুর দিন থেকে ভাই নোমান নুসরাতকে পরীক্ষার হলে বসিয়ে দিয়ে আসতেন। ৬ এপ্রিল তিনি তাই করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর খবর শুনে ডা. সামন্ত লাল সেনকে জড়িয়ে ধরে নুসরাত জাহানের বাবার কান্না। ছবি : পিবিএ
যেভাবে পোড়ানো হয় নুসরাতকে
নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান গণমাধ্যমের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
নোমান বলেন, ৬ এপ্রিল ছিল আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা। সকালে বোনকে নিয়ে পরীক্ষার হলে বসিয়ে দেওয়ার জন্য মাদ্রাসায় ঢোকার সময় মাদ্রাসার অফিস সহকারী মোস্তফা তাঁকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন। নুসরাত পরীক্ষার হলে বসলে সাড়ে ৯টার দিকে অধ্যক্ষের পক্ষের কয়েকজন ছাত্রী নুসরাতকে ডেকে ছাদে নিয়ে যায় এবং মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। নুসরাত তাতে রাজি না হওয়ায় তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন নিয়ে নুসরাত নিচে দৌড়ে এলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠান।
অধ্যক্ষের কক্ষে যা ঘটেছিল
নুসরাতের মাদ্রাসায় দশম শ্রেণিতে পড়ে ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান। দগ্ধ বোনের বরাত দিয়ে সে জানায়, গত ২৭ মার্চ দুপুর পৌনে ১২টার দিকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা তাঁর পিয়ন নুরুল আমিনকে দিয়ে নুসরাতকে অধ্যক্ষের রুমে ডেকে নেন। নুসরাত তখন আরো তিন-চারজন বান্ধবীকে নিয়ে অধ্যক্ষের রুমে ঢুকতে চাইলে শুধু তাঁকে ঢুকতে দেন পিয়ন। এরপর দরজা আটকে অধ্যক্ষ বিভিন্ন প্রলোভন দেখান। ১ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে তাঁকে প্রশ্ন দেওয়া হবে, যদি তিনি অধ্যক্ষের কুপ্রস্তাবে রাজি হন। এরপর অধ্যক্ষ নুসরাতের শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর নুসরাত দৌড়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে যান।
এরপর মাদ্রাসায় থাকা ছোট ভাই রায়হানকে খবর দেওয়া হলে সে বোনের কাছে যায়। এরপর অধ্যক্ষ তাকে জানান, তার বোন অসুস্থ। অসুস্থ থাকার কারণে অধ্যক্ষের কাছে এসেছিল ছুটির আবেদন করতে। এখানে এসে আবার সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
সেখান থেকে নুসরাতকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর কিছুটা সুস্থ হলে স্বজনদের জানান, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিলেন। এরপরে ক্ষুব্ধ হয়ে স্বজনরা মাদ্রাসায় গিয়ে অধ্যক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তবে তিনি ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন। এরপর মাদ্রাসা অধ্যক্ষ উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতাকে ফোন দেন। আওয়ামী লীগের নেতা পুলিশসহ মাদ্রাসায় যান। তবে মাদ্রাসায় গিয়ে সব ছাত্রছাত্রীর মাধ্যমে সত্য ঘটনা জানতে পেরে পুলিশ অধ্যক্ষকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এরপর নুসরাতের মা বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় পরের দিন তাঁকে আদালত পাঠানো হয়। আদালত তাঁর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। আজ আদালত তাঁর সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রায়হান আরো জানায়, ৬ এপ্রিল সকালে মাদ্রাসায় গেলে এক ছাত্রী তাঁর বোন নুসরাতকে বলে যে তাঁর বান্ধবী নিশাতকে কারা যেন ছাদে মারধর করছে। পরে নুসরাত মাদ্রাসার তৃতীয় তলার ছাদে গেলে সেখানে বোরকাপরা ও হাতে মোজা লাগানো চার ছাত্রী তাঁকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। বলে, মামলা তুলে না নিলে তাঁকে মেরে ফেলা হবে। এরপর নুসরাত মামলা তুলে নেওয়ার কথা প্রত্যাখ্যান করে তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টার বিচার দাবি করেন। পরে ওই চারজন তাঁর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর তারা পালিয়ে যায়।