‘নুসরাতের ঘটনা প্রমাণ করে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে’
মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে দেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। আজ শনিবার বিকেলে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার উত্তর চরচান্দিয়ায় নুসরাতের গ্রামের বাড়িতে তাঁর পরিবারকে দেখতে এসে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
মওদুদসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা নুসরাতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানান। পরে বিএনপি নেতারা নুসরাতের কবর জিয়ারত করে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, মো. শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব ব্যরিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, বিএনপি নেত্রী নিপুণ রায় প্রমুখ।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার এই চরম অবনতি আর দেখতে চাই না। তারা আমাদেরকে, এটাকে আমি রাজনৈতিকভাবে জিনিসটা নিতে চাই না। শুধু বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে আমাদের পুলিশকে রাজনৈতিক বিরোধী দলকে নিপীড়ন করার জন্য রাখা হয়েছে। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করার জন্য রাখা হয় নাই। যদি আজকে তাই হতো, যদি পুলিশ বাহিনী আজকে সত্যিকার অর্থে কর্মক্ষম হতেন, দক্ষ হতেন এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটতো না।’
নুসরাতের হত্যাকারী ও এর সঙ্গে জড়িত সবার কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘এই অপরাধের বিচার হওয়া উচিত এবং কঠোরতম শাস্তি দেওয়া উচিত এদের (দোষীদের)। যাতে কোনোদিনই বাংলাদেশের মাটিতে এই ধরনের নুসরাতের মতো একটি নিরীহ, একটি কিশোরী, একটি পড়ুয়া মেয়ের জীবননাশ না হয়। এই ধরনের যাতে কোনো নুসরাতের জীবন নষ্ট না হয় আর। এবং একটা জিনিস প্রমাণ করেছে যে নুসরাত জীবন দিয়ে সে প্রমাণ করেছে একজন সাহসী একজন কিশোরী ছিলেন তিনি। তার জানাজায় এই যে হাজার হাজার মানুষ হলো, লক্ষ মানুষ হয়েছে। কেন? কেন হয়েছে? নুসরাতের প্রতি তাদের সমবেদনা এবং নুসরাত যে সাহসের পরিচয় দিয়েছে এবং সাহসের সঙ্গে সেই অবস্থা মোকাবিলা করেছে, এইগুলো দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকবে আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীদের জন্য।
জাবেদ সাতদিনের রিমান্ডে
এদিকে নুসরাত হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি জাবেদ হোসেনকে আদালতে উপস্থাপন করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের শাহ আলম। ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক জাকির হোসেন আসামি জাবেদ হোসেনের সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর ও মামলার ৪ নম্বর আসামি মাকসুদ আলমের রিমান্ডের শুনানি সোমবার অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত আরেক আসামি শাহাদাত হোসেন শামীমকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআইয়ের সদস্যরা। শুক্রবার গভীর রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। নূর উদ্দিনের পর শামীমও অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার ঘনিষ্টসহচর হিসেবে পরিচিত।
এ ছাড়া, নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ফেনী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংগঠেনর পক্ষ থেকে আজ মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
১৩ জন সম্পৃক্ত
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি আটজন হলেও হত্যাকাণ্ডে এ পর্যন্ত ১৩ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে মামলাটির তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাতজনকে। এরমধ্যে আসামি নূর উদ্দিন রিমান্ডে হত্যার কথা স্বীকার করে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
এজাহারভুক্ত আট আসামির মধ্যে পরিকল্পনাকারী শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), নূর উদ্দিন (২০), কাউন্সিলর মাকসুদ আলম (৪৫), জোবায়ের আহমেদ (২০), জাবেদ হোসেন (১৯) ও আফসার উদ্দিনকে (৩৫) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়াও তদন্তের স্বার্থে কয়েকজন সন্দেহভাজনকে নজরদারীর মধ্যে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে পিবিআই। বার্তা সংস্থা বাসসের এক খবরে এসব জানানো হয়েছে।
একই ঘটনায় আগে শ্লীলতাহানির অভিযোগে গ্রেপ্তার সোনাগাজী ইসলামি ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে নুসরাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এজাহারভুক্ত অপর আসামি হাফেজ আব্দুল কাদের পলাতক রয়েছেন।
মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআই আজ শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ড মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার নির্দেশে ঘটেছে।
রাজধানীর ধানমণ্ডিতে পিবিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, অধ্যক্ষের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ডের এ ঘটনা ঘটেছে। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। গত ৪ এপ্রিল আসামি নূর উদ্দীন ও শাহাদাতসহ কয়েকজন কারাগারে গিয়ে সিরাজ উদ দৌলার সঙ্গে দেখা করেন। তখন সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে কিছু একটা করার নির্দেশনা দেন। এরপর ৫ এপ্রিল সকালে নূর উদ্দিনসহ কয়েকজন মিলিত হয়ে পরিকল্পনা করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন, নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হবে।
বনজ কুমার মজুমদার জানান, আসামি নূর উদ্দিন ঘটনার দায় স্বীকার করে আগুন দেওয়ার ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। পরিকল্পনামতো তিনটি বোরকা ও কেরোসিন আনার দায়িত্ব পড়ে শম্পা নামে এক ছাত্রীর ওপর। শম্পা মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষের শ্যালিকার মেয়ে। ওই ছাত্রী কথা মতো ৬ এপ্রিল শনিবার সকাল ৯টায় শাহাদাতের কাছে কেরোসিন ও বোরকা হস্তান্তর করেন। সকাল ৯টার পর ওই মাদ্রাসার ভবনের ছাদে চারজন অবস্থান নেন। পরিকল্পনায় অংশ নেওয়া শম্পা ওরফে চম্পা নামে ওই ছাত্রী নুসরাতকে জানান, তাঁর সহপাঠী নিশাতকে ভবনের ছাদে মারধর করা হচ্ছে। ওই খবরে নুসরাত ছাদে গেলে তাঁকে আটকে দেওয়া হয়। প্রথমে ওড়না দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। মাদ্রাসার বাইরে নূর উদ্দিনের নেতৃত্বে চার-পাঁচজন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ও গেট পাহারা দেন। আগুন দেওয়ার পর সরাসরি অংশ নেওয়ারা বোরকা পরে বের হয়ে যান।
হত্যার কারণ
ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, যৌন নির্যাতনের মামলা হওয়ায় আলেম সমাজকে হেয় করা হয়েছে- এই ধরনের ‘যুক্তি’ দিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা জেলে থেকেই তাঁর সাঙ্গপাঙ্গোদের নির্দেশ দেন নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারার। অধ্যক্ষ তাদের জানান, নুসরাত প্রথমত মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ আলেম সমাজকে হেয় করেছে, দ্বিতীয় কারণ হলো- শাহাদাত নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কোনোভাবেই তা মেনে নেননি। এই রাগে অধ্যক্ষের সহযোগীরা ও শাহাদাত নুসরাতকে হত্যা করে।
গত ৬ এপ্রিল নুসরাত জাহান রাফি মাদ্রাসায় পরীক্ষা দিতে গেলে একদল দুর্বৃত্ত তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে দগ্ধ অবস্থায় ওই দিন সন্ধ্যায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। গত ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নুসরাত মারা যান।
এর আগে গত ২৭ মার্চ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে মামলা করেন নুসরাতের মা।
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের কবরের পাশে দোয়া করেন বিএনপির নেতারা। ছবি : এনটিভি
ক্যাপশন ৩
শনিবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে পিবিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন সংস্থাটির প্রধান বনজ কুমার মজুমদার। ছবি : এনটিভি