‘সন্তানদের দিকে তাকাতেই লজ্জা করে, বৈশাখ আবার কিসের?’
আশুরা বেগম (৪৫) রাজধানী ধানমণ্ডি লেকে ১০ বছর ধরে ভিক্ষা করেন ছেলে-মেয়ে নিয়ে। থাকেন মিরপুর বেড়িবাধের ওপারে অবস্থিত সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়নে। চার মেয়ে আর এক ছেলে সন্তানের জননী তিনি।
স্বামী আলামিন হোসেন নেশা করেন, খেলেন জুয়া। খোঁজ নেন না স্ত্রী-সন্তান কারোর। তিন বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করাসহ সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারেন না আশুরা বেগম। সন্তানদের নিয়ে ভিক্ষার পাশাপাশি মাস খানেক ধরে সিগারেট বিক্রি শুরু করেছেন আশুরা বেগম।
আশুরা বেগমের পাঁচ সন্তানের ভেতরে চারজন লেখাপড়া করে। ভোর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ভিক্ষাসহ সিগারেট বিক্রি করেও স্কুলের খরচ দিতে পারছেন না সন্তানদের। এদিকে তিন মাসের বাসা ভাড়া বাকি। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত রোগের কবলে পড়লে সন্তানদের চিকিৎসা করাতেও পারেন না তিনি।
এদিকে বাঙালির প্রাণের উৎসব দরজায় কড়া নাড়ছে। রোববার পয়লা বৈশাখ। বৈশাখের প্রসঙ্গ তুলতেই আশুরা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, ‘দুই বছরে কাউরে নতুন জামা কিনে দেই নাই। মাইনষে দেয় পুরান কাপড়। অনুষ্ঠানের দিন (পয়লা বৈশাখ) তিন মেয়েকে নিয়ে ভিক্ষা করব। ওই টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া দেব। ছেলে-মেয়েদের স্কুলের টাকা দেব। ওদের দিকে তাকাতেই লজ্জা করে, বৈশাখ আবার কিসের?’
রাজধানী ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বরই তলায় মাটিতে শুয়ে ফিডার খাচ্ছে আশুরা বেগমের ছোট মেয়ে আফিয়া। ছবি : এনটিভি
শুক্রবার সকালে রাজধানী ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বরই তলায় গিয়ে দেখা যায়, আশুরা বেগম সিগারেট বিক্রি করছেন। মাটিতে শুয়ে আছে প্রতিবন্ধী ছোট মেয়ে আফিয়া (১৫ মাস)। পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেজ মেয়ে লামিয়া (৮) আর সেজ মেয়ে সামিয়া (৭)। বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন না ছোট অফিয়াকে। দুধ কেনার টাকা নেই বলে ফিডারে চিনি মিশ্রিত পানি ভরে খাওয়াতে দেখা গেছে আশুরা বেগমকে। তখন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে এসব কথা বলেন আশুরা বেগম।
আশুরা বেগম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার চার মেয়ে আর এক ছেলে। থাকি মিরপুর বেড়িবাধের ওই পাশে কাউন্দিয়াতে। বড় ছেলে সোহেল হোসেন (১৪) কাউন্দিয়ার শহীদ স্মৃতি স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। খুব ভালো পড়া পারেও। বড় মেয়ে মীম (১২) ক্লাস ফাইভে, মেজ মেয়ে লামিয়া (৮) ক্লাস থ্রিতে আর সেজ মেয়ে সামিয়া (৬) পড়ে নার্সারিতে। তিন মেয়ে কাউন্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। আগে সবাইকে দিয়ে ভিক্ষা করাতাম। এখন ছোট তিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষা করি। বড় ছেলে আর বড় মেয়ে লজ্জা পায় ভিক্ষা করতে। লোকজনের কাছে টাকা চাইলে অনেক কথা শোনায়। লোকজনের কথা আর শুনতে পারি না, তাই সিগারেট বিক্রি শুরু করছি। এতে কিছু টাকা হয়। এই টাকায় বাজার খরচটা চলে।’
রাজধানী ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বরই তলায় মাটিতে শুয়ে ফিডার খাচ্ছে আশুরা বেগমের ছোট মেয়ে আফিয়া। ছবি : এনটিভি
আশুরা বেগম বলেন, ‘ওদের (ছেলে-মেয়ে) বাবা আমাদের খোঁজ নেয় না। কই থাকে জানি না। তবে নেশা করে আর জুয়া খেলে। ছোট মেয়ে পেটে যাওয়ার পর আর কোনো দিন দেখা হয়নি তার সাথে। ছোট মেয়েকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারি না। ফিডারে করে চিনি গুলাইয়া পানি খাওয়াই। আল্লাহ হয়তো আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। এভাবে আর পারছি না বাবা। আমি মরে গেলে আমার ছেলে-মেয়েদের কী হবে জানি না।’
আশুরা বেগম বলেন, ‘কাল মেজ মেয়ে কানছিল (কাঁদছিল) ওর জামা ছিড়ে গেছে তাই। মেয়ে কইলো, মা একটা জামা দাও কিনে। পাশের বাড়ির এক লোক তাঁর মেয়েকে বৈশাখের নতুন জামা কিনে দিয়েছে বলে আমার বড় মেয়ে মীম মন খারাপ করে কইলো, আমার বাবা কি আমাকে কখনো জামা কিনে দিয়েছিল মা? বাবা কি আর আসবে না কোনো দিন? বলেই মীম কাইন্দা দিল। আমিও কেন্দে দিলাম। আমি অভাগা মা, এগুলো সহ্য করতে পারি না।’
‘আমাদের মতো গরিবের বৈশাখ-টৈশাখ থাকতে নেই। শুনি লোকে বৈশাখে ইলিশ খায়। কত বছর যে ইলিশ চোখে দেখি নাই ঠিক নাই। দুই হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেই। তিন মাসের ভাড়া বাকি। ঘরের মালিক কবে যে নামাইয়া দেয় সেটা শুধু ভাবছি। বৈশাখের দিন তিন মেয়েকে নিয়ে সবার কাছে যাব। কিছু বেশি টাকা হলে বড় ছেলের স্কুলের বেতন আর প্রাইভেটের টাকা দিতে পারব।’
আশুরা বেগমের পাশে থাকা মেজ মেয়ে লামিলা বলে, ‘ছুটির দিনে এখানে আসি। লোকের কাছে টাকা চাই। ওই টাকা দিয়ে পড়ি আমরা। বাসা ভাড়ার টাকা দেয়। কালকে বৈশাখের দিন লেকে ফুল বেচব আর টাকা চাব। জামা নেই একটাও। সব ছিড়ে গেছে। মার কাছে টাকা হলে কিন্না দেবে। আমরা কোনো বৈশাখই পালন করি না। লোকের বৈশাখ দেখি।’