প্যারিস থেকে পয়লা বৈশাখে, নেদারল্যান্ডস থেকে রমনায়
বর্ষবরণের সর্বজনীন উৎসব পয়লা বৈশাখের আয়োজনে বাঙালির সংস্কৃতির নানা মনোমুগ্ধকর রূপ দেখতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বাঙালিদের মতো জড়ো হয়েছেন বিদেশি নাগরিকরাও।
পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী রমনার বটমূলের ছায়ানটের বর্ষবরণের ধ্রুপদী অনুষ্ঠান কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছেন ভিনদেশিরাও।
কেউ কেউ একেবারে সাধারণ বাঙালির সাজে সেজে হাঁটছেন রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চারুকলার বকুলতলা, টিএসসি চত্বর, মলচত্বর হয়ে শাহবাগের পথে পথে। বিস্ময় ভরে দেখছেন, কথা বলছেন মানুষের সঙ্গে, নিজের ভাববিনিময় করছেন। আর পছন্দ হলে ফুটপাত থেকে কিনে নিচ্ছেন নিজের পছন্দের কোনো গয়না, চুড়ি, টিপ বা নিদেপক্ষে একটা বাঁশি।
বাঙালির পয়লা বৈশাখ উদযাপন দেখতে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে এসেছেন মেলেনা। জানালেন, এই উৎসব দেখতে তাঁদের নারী-পুরুষ ১৩ জনের একটি দল এবার ঢাকায় এসেছে। মূলত বাঙালি সংস্কৃতির নানা রূপ দেখতেই তাঁদের এই ভ্রমণ বলে জানান মেলেনা।
রোদকে উপেক্ষা করে মেলেনাদের দলটির সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে ঘুরছেন। মেলেনার হাতে একটা ছাতা। একজনের হাতে একটা ক্যামেরা, সারাক্ষণই ছবি তুলে চলেছেন।
ফরাসি মেলেনা ইংরেজিতে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা মোট ১৩ জন ট্যুরিস্ট বাংলাদেশে এসেছি গত ১২ এপ্রিল। এক সপ্তাহের জন্য এসেছি এখানে। আগামী ১৯ এপ্রিল আমরা চলে যাব ফ্রান্সে। বাঙালি কালচার খুব সুন্দর।'
কেন এসেছেন এমন প্রশ্নে মেলেনা বলেন, ‘বাংলাদেশে আগেও একবার এসেছিলাম। তখন মূলত এই দেশের অনেক কিছু ভালো লাগেছিল। তারপর বাংলাদেশ নিয়ে লেখাপড়া করেছি, আরো অনেক জেনেছি। ১৯৭১ সালে আপনারা স্বাধীন হয়েছেন। শেখ মুজিব জাতির পিতা। আরো অনেক সংস্কৃতি সম্পর্কে আমি জানি। তবে এবার শুধু পয়লা বৈশাখ উৎসব দেখতেই বাংলাদেশে এসেছি।'
মেলেনার সঙ্গে ছিলেন রিয়াংকি পিঞ্জু। তিনি বলেন, ‘কী সুন্দর লাল-সাদা শাড়ি! এটা আমার পছন্দ হয়েছে। সবাই প্রায় একই রঙের পোশাক পরেছে। বাংলাদেশ খুব সুন্দর দেশ। এক সপ্তাহ খুব মজা হবে বলে মনে হচ্ছে।’
কী কী দেখলেন—এমন প্রশ্নে রিয়াংকি বলেন, ‘ভোরে গান শুনেছি। তার পর থেকে এই এলাকায় ঘুরে ঘুরে দেখছি। ভালো লাগছে।’
রমনা উদ্যানে নেদারল্যান্ডসের এক নাগরিককে দেখা গেছে বৈশাখী শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। চোখেমুখে আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ঢাকায় থেকে ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, শাড়ি পরতে ভালো লাগে। এটা চমৎকার পোশাক। শাড়ি পরে ঘুরছি৷ অনেক মজা হচ্ছে।
জীর্ণ-পুরাতনকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করেছে বাঙালি জাতি। পয়লা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মেতেছে দেশ। চৈত্রসংক্রান্তির মাধ্যমে ১৪২৫ সনকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হয়েছে নতুন বছর ১৪২৬।
১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে।
পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে।
দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পয়লা বৈশাখের আয়োজনে।
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।