শবেবরাত এলেই বিচারের জন্য আল্লাহর দরবারে কাঁদেন মা
‘শবে বরাত এলেই শোকে কাতর হয়ে যায় কামরুজ্জামানের মা। সারারাত কান্নাকাটি করে আর আল্লাহর কাছে বিচার চায়। আমার ছেলের নামে ডাকাতির মিথ্যা মামলা দিয়েছিল। পবিত্র রাত বলে আল্লাহর অশেষ রহমতে সত্য ঘটনা উৎঘাটন হয়েছে। সরকারই যখন মামলার বাদী তখন বিচারের দাবিতে সরকারের দিকেই তাকিয়ে আছি।’
এভাবেই কান্নার সুরে বলছিলেন আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে নিহত কামরুজ্জামান অন্তুর বাবা আব্দুল কাদের। বাঙলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন কামরুজ্জামান।
মামলাটি আট বছর পার হলেও শেষ হয়নি বিচার। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শাকিলা জিয়াসমিন মিতু এনটিভি অনলাইনকে জানান, এ মামলায় দুজন তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য বাকি রয়েছে। তাঁরা আদালতে সাক্ষী দিতে না আসায় মামলার বিচার কাজে বিলম্ব হচ্ছে। এ ছাড়া সব আসামি জামিনে মুক্ত আছেন।
শাকিলা জিয়াসমিন বলেন, তদন্ত কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য শেষ হলেই মামলাটিতে আসামিপক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তিতর্ক শুনানি হবে। এর পরই রায় নির্ধারণ করা হবে। আগামী ২৮ এপ্রিল মামলার সাক্ষীর দিন নির্ধারণ করা আছে।
বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মদ জানান, পুলিশ এ মামলায় সহায়তা করছে না। তারা মামলাটি ভিন্ন খাতে নিতে চেয়েছিল। এজন্য তারা সাক্ষীদের আদালতে আনতে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ মামলায় অনেক আসামি স্বীকারোক্তমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হবে বলে আমি আশাবাদী।
২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের কেবলাচরে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে কামরুজ্জামান অন্তুসহ ছয়জন নিহত হন। বাকিরা হলেন- ধানমণ্ডির ম্যাপললিফ স্কুলের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম শাম্মাম, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল, বাঙলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ, তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান, মিরপুরে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবীর মুনিব ।
নিহতদের সঙ্গে থাকা বন্ধু আল আমিন গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান।
ওই ঘটনার পর ডাকাতির অভিযোগে আল আমিনসহ নিহতদের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় একটি ডাকাতির মামলা করেন স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী আবদুল মালেক।
ওই সময় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় গ্রামবাসীকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করে। পরে মামলাটি তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ উদ্দিন আহমেদ ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এ অভিযোগপত্রের পরে মামলাটি বিচারের জন্য এই আদালতে এলে ২০১৩ সালের ৮ জুলাই ৬০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এ ছাড়া ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া আল আমিনকে একই ঘটনায় করা ডাকাতি মামলা থেকে সেদিন অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ঘটনার পর কথিত ডাকাতির অভিযোগে বেঁচে যাওয়া আল-আমিনসহ নিহতদের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগে একটি মামলা করেন স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী আবদুল মালেক (বর্তমানে এ মামলার আসামি) এবং পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করে।
এ হত্যার ঘটনায় সাভার থানা পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হলে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। একই সঙ্গে থানা পুলিশের ভূমিকা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি করে পুলিশ সদর দপ্তর। ওই কমিটি তথ্যানুসন্ধানের পর মত প্রকাশ করে, ওই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা ছিল ‘অপেশাদার ও দায়িত্বহীন।’
অন্যদিকে ওই ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রটেকশন অব হিউম্যান রাইটসের মহাসচিব আইনজীবী তাজুল ইসলাম ২০১২ সালের জুলাইয়ে একটি রিট আবেদন করেন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। চূড়ান্ত শুনানির পর হাইকোর্ট বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন।
বিচার বিভাগীয় তদন্তে নিহত ব্যক্তিরা ডাকাত নয় বলে প্রতিবেদন দেওয়া হলে সাভার থানার পুলিশ থেকে তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি।
কিন্তু সিআইডির তদন্ত সন্তোষজনক না হওয়ায় হাইকোর্ট ২০১২ সালের ৭ আগস্ট র্যাবের কাছে তদন্তভার হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়। র্যাবকে চার মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
র্যাবের তদন্তের আগে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. সিরাজুল হক মামলাটির তদন্ত করে আসছিলেন। তারও আগে সাভার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মতিয়ার রহমান মিয়া মামলাটির তদন্ত করেছিলেন।
হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে ছয়জন পলাতক, ৫৩ জন জামিনে এবং এক আসামি মৃত্যুবরণ করেছেন। এ মামলায় ১৪ আসামি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।