ওয়াসার পানি একশত ভাগ সুপেয়, দাবি এমডির
ঢাকা ওয়াসার পানির নিম্নমাণের কারণে তা ফুটিয়ে খেতে বছরে প্রায় ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস খরচ হয়, দুর্নীতি বিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি থেকে প্রকাশিত এমন গবেষণা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে ঢাকা ওয়াসা।
আজ শনিবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে ওই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। তিনি বলেন, ওয়াসার পানি একশতভাগ সুপেয়।
টিআইবি যে পদ্ধতিতে এ গবেষণা করেছে সেটি একপেশে ও উদ্দেশ্যমূলক বলেও মন্তব্য করেন তাকসিম এ খান। তিনি বলেন, ৩৩২ কোটি টাকার অপচয়ের বিষয়ে টিআইবির গবেষণা অনুমাননির্ভর ও বাস্তবতা বিবর্জিত।
তাকসিম এ খান বলেন, ‘এ বছরই আমরা সাশ্রয় করেছি ৬০০ কোটি টাকা, যেটা ম্যাথামেটিক্যালি রাইট। আর আপনি হাইপোথেটিক্যালি বলে দিলেন যে ৩৩২ কোটি টাকা গ্যাস অপচয় হয়। এটা সঠিক নয়। সে কারণে আমরা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এই প্রতিবেদনকে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম।’
ওয়াসার এমডি দাবি করেন, ‘আমাদের প্রত্যেকটা জায়গায় একশত ভাগ পরীক্ষা করেই আমরা পানিকে দেই এবং সেই পানি একশত ভাগ, একশত ভাগ সুপেয়। বিপত্তি কোথায় হয়? আপনারা জানেন অনেক সময় পাইপগত। আমরা সমস্ত পাইপ পরিবর্তন করে ফেলছি। দ্বিতীয়ত বিপত্তিটা হয়, আমাদের বাসার যে সমস্ত আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার থাকে, সেটা অপরিষ্কার থাকার কারণে হয়।’
এর আগে গত বুধবার সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে নিজস্ব কার্যালয়ে ‘ঢাকা ওয়াসা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে টিআইবি। সেই সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার পরিচালনা বোর্ড একটি অকার্যকর বোর্ডে পরিণত হয়েছে। আর এ কারণে ওয়াসায় জবাবদিহিতার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।
সুপেয় পানি সরবরাহ করার কথা থাকলেও ঢাকা ওয়াসার পানিতে মানুষের আস্থা নেই উল্লেখ করে টিআইবি জানায়ম ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করছে। আর তাতে প্রতি বছর অপচয় হচ্ছে ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস।
ওয়াসার সেবার মান, দুর্নীতি, গ্রাহক সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি, অনিয়ম, সীমাবদ্ধতা, চ্যালেঞ্জের তথ্য তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গ্রাহকদের ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশই ওয়াসার সেবায় অসন্তুষ্ট। গবেষণায় ১৩ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘একটি বিষয় লক্ষণীয় সেটা হচ্ছে, ওয়াসার একটি পরিচালনা বোর্ড আছে সেটি অকার্যকর বললেই চলে। বিশেষ করে সেখানে অকার্যকরতার প্রধান কারণ সরকারি প্রভাব। অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবের চেষ্টা করা হয়। এই সুযোগে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রায় একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর মাধ্যমে একচ্ছত্রভাবে পরিচালিত হচ্ছে জবাবদিহিতার ঘাটতির অন্যতম কারণ হচ্ছে এটি।’
বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রাহক সেবা কার্যক্রমে গতিশীলতা আনার চেষ্টা করলেও ঢাকা ওয়াসার পানি ও পয়নিষ্কাশন সেবায় এখনো ব্যাপক সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। বিশেষ করে, সার্বিকভাবে পানি ও পয়নিষ্কাশন সেবার নিম্নমানের কারণে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি সেবাগ্রহীতার অসন্তুষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে অধিকতর কার্যকর ও সেবাধর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে ১৩ দফা সুপারিশ দিয়েছে টিআইবি।
গবেষণাটিতে ঢাকা ওয়াসার আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক নানা সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার পাশাপাশি পানি সেবা, পয়নিষ্কাশন সেবা, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা ও কার্যকারিতা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটির নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি চিহ্নিত করে সেগুলো নিরসনে সুপারিশ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, আগের তুলনায় ঢাকা ওয়াসার উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক অর্জন ও উদ্যোগ রয়েছে। যেমন : সিস্টেম লস কমিয়ে আনা; রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি; ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিলের তথ্য জানা এবং মোবাইল ফোন ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিল পরিশোধ ব্যবস্থার পাশাপাশি পরীক্ষামূলকভাবে ডিজিটাল বিলিং সিস্টেম চালু করা; সার্বক্ষণিক অভিযোগ গ্রহণে হটলাইন স্থাপন; কমিউনিটি প্রোগ্রাম ও কনজ্যুমার রিলেশন বিভাগ গঠন; ৮০টি ওয়াটার এটিএম বুথের মাধ্যমে খুচরা পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা; ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে ও জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প গ্রহণ ইত্যাদি।
তবে প্রতিষ্ঠানটির নানা কার্যক্রম পরিচালনায় এখনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান। অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ওয়াসা বোর্ডের কার্যকারিতায়ও ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা ওয়াসা সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিতে সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি আইনের কার্যকর প্রয়োগেও ঘাটতি লক্ষণীয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পানির চাহিদা পূরণ, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পানি উৎপাদন এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতে সক্ষমতার ঘাটতি বিদ্যমান।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, পয়ঃনিষ্কাশন সেবায় সক্ষমতা ও কার্যকারিতার ঘাটতির কারণে প্রতিদিন ১৩ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত পয়ঃবর্জ্য বিভিন্ন খাল হয়ে পাশের নদীগুলোতে যায়। এতে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী নদী দূষণে ঢাকা ওয়াসারও দায় থেকে যায়। ১৯৯০ সালের পর ঢাকা ওয়াসা নতুন কোনো পয়ঃলাইন তৈরি করেনি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ট্রিটমেন্ট প্লান্ট আছে মাত্র একটি, যেটিও আবার সক্ষমতার মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ ব্যবহার করে। ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনেও ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা ও কার্যকারিতায় ব্যাপক ঘাটতি বিদ্যমান।
গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা ওয়াসার নিয়োগ, পদায়ন ও বদলি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণসহ ক্রয় প্রক্রিয়া, প্রকল্প বাস্তবায়ন, মিটার রিডিং নেওয়া এবং সর্বোপরি গ্রাহক সেবায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান।
এপ্রিল ২০১৮ থেকে মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন তথ্যের বিবেচ্য সময়সীমা ছিল ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। গবেষণাটি মিশ্র গবেষণা পদ্ধতিতে (গুণবাচক ও পরিমাণবাচক) পরিচালিত হয়েছে এবং উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি হিসেবে সেবাগ্রহীতা জরিপ, মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার এবং পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। আর পরোক্ষ তথ্যের উৎস হিসেবে পানি ও পয়সেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রবন্ধ, গবেষণা প্রতিবেদন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ, সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করা হয়েছে।