রাত ৮টার দিকে হঠাৎ মুঠোফোনে মায়ের অসুস্থতার খবর পান আকাশ (ছদ্মনাম)। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বাসের টিকেট কাটেন তিনি। বাস ছাড়ার ঠিক ১৫ মিনিট আগে টিকেট কাটেন সাদ্দাম হোসেন। রাত ১১টায় ঢাকার কল্যাণপুর থেকে সাতক্ষীরার উদ্দেশে ছেড়ে যায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) এসপি গোল্ডেন লাইন পরিবহনের বাস। আকাশের পাশের সিটে বসেন সাদ্দাম।

আকাশের গন্তব্য সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া বাসস্ট্যান্ড। গল্পের ছলে সাদ্দাম হোসেন যশোর নিউমার্কেট যাবেন বলে জানান আকাশকে। বাস চলতে থাকে। কখনো-সখনো কথা হয় তাঁদের মধ্যে। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পার হওয়ার পর আর কথা হয়নি তাঁদের। এরপর বাসের সিটে বসেই অচেতন হয়ে পড়ে থাকেন আকাশ।

কলারোয়া পৌঁছানোর পর বাসের কন্ট্রাক্টর আকাশকে ডাকতে গিয়ে দেখেন, অচেতন হয়ে পড়ে আছেন তিনি। এরপর বাস থামিয়ে তাঁকে এসপি গোল্ডেন লাইনের কাউন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘুমে টলছিলেন আকাশ। চোখে-মুখে পানি ছিটানোর পর একটু একটু চেতনা ফিরে আসে। টের পান পাশে বসা সাদ্দাম ক্লোরোফোমের সাহায্যে তাঁকে অজ্ঞান করে স্মার্টফোনটি নিয়ে গেছে। কন্ডাক্টরের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, সাদ্দামের যশোর নামার কথা থাকলেও নেমে যান পাটুরিয়া ফেরিঘাটে।

এ ঘটনা ঘটার পর এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় আকাশের। কথা হলে তিনি ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন এই প্রতিবেদককে। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতেই পারিনি এমন একটি ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটবে। ঘুমে অজ্ঞান অবস্থা থেকে যখন আমাকে বাস থেকে নামানো হলো, তখন মনে হচ্ছিল আমি ঘুমে দাঁড়াতে পারছি না। শরীরে তেমন শক্তি পাচ্ছিলাম না। তবে কাউন্টার থেকে বাড়িতে যেতে পারব বলে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। বাড়ি গিয়ে বহু ঘণ্টা ঘুমানোর পর চিকিৎসক এসে ওষুধপত্র দেন। কয়েক দিন পর শরীরে সতেজতা ফিরে পাই।’

আকাশ আরো বলেন, ‘আমার মনেই হয়নি এ রকম একটি ঘটনা ঘটবে। অজ্ঞান পার্টির লোকটাকে দেখেও বোঝার উপায় ছিল না। বেশ সুন্দর করেই কথা বলে। সে আমাকে চানাচুর খেতে বলেছিল। কিন্তু আমি খাইনি। এরপর সে সম্ভবত আমার নাকে কিছু একটা শুঁকিয়েছিল। তারপর এ ঘটনা ঘটল।’

পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এটা প্রায় নিয়মিত ঘটনা। অধিকাংশ পরিবহনে এ ঘটনা ঘটছে বর্তমানে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কিছুই করার থাকছে না। কারণ, ছিনতাইকারীরা সাধারণ মানুষদের মতো করে টিকেট কেটে বাসে উঠছে। কেবল ঠিকানা আর মুঠোফোন নম্বর ভুল দিচ্ছে। এতে ছিনতাইকারীকে শনাক্ত করা তাদের জন্য কঠিন।

শুধু আকাশ নয়, গত বৃহস্পতিবার যশোর থেকে নজরুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী ঢাকায় আসার পথে মলম পার্টির শিকার হয়েছেন। দৌলতদিয়া ফেরিঘাট পার হওয়ার পর এ ঘটনা ঘটে। এতে তাঁর মুঠোফোন ও গলার চেইন খোয়া যায়। তিনি বলেন, আমি যশোর থেকে একে ট্রাভেলসের বাসে উঠেছিলাম। ফেরি পার হয়েছি ভালোভাবে। তখনো ফোন আমার হাতে। ফেরি পার হয়ে আড়াই ঘণ্টা পর যখন ঢাকায় টেকনিক্যাল এসে নামব, তখন আর আমার ফোন ও চেইন পাইনি। ঘুমে টলছিলাম। পাইনি পাশে বসা লোকটিকেও। ওই লোকই আমার জিনিস নিয়ে গেছে। কন্ট্রাক্টরকে জানিয়েছি। তিনি জানালেন, কিছুই জানেন না। ওই লোক তো নেমে গেছে তাদের সামনে দিয়েই। তারা তো কিছুই জানেন না।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে এসপি গোল্ডেন লাইনের কলারোয়া কাউন্টারের ব্যবস্থাপক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘এটা খুবই সচরাচর ঘটনা। এভাবে টিকেট কেটে বাসে উঠে ঘুমের সময়ে চুরি করে নিয়ে যেতে চোরদের খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয় না। কাজ সেরে চুপিসারে বাস থেকে নেমে যেতে পারে। এটা শুধু এসপি গোল্ডেন লাইনে নয়, সব বাসেই ঘটে। কিন্তু আমাদের কিছুই করার থাকে না। কারণ আমরা তো জানি না, আমাদের কোন যাত্রী ছিনতাইকারী বা ভালো। মূলত এরা সংঘবদ্ধ চক্র। এরা বাসে উঠবে, অজ্ঞান করে ছিনতাই করে নেমে যাবে। আবার একটি বাসে উঠে ঢাকা যাবে, তখনো সে একই কাজই করবে। প্রশাসন পারে এদেরকে ধরতে।’

এ ছাড়া ছিনতাইয়ের বিষয়ে জানতে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, কিং ফিশার ট্রাভেলস, কে লাইন, আর এম ট্রাভেলসসহ কয়েকটি পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। তাদের ভেতরে অধিকাংশ ব্যবস্থাপকই জানান, এসব ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটে। কিন্তু তাদের কিছু করার থাকে না। তবে দুজন জানান, হয়তো ঘটে, তবে সেটা সব সময় না।

এদের ভেতরে যশোরের একটি বাসের একজন কাউন্টার ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব ছিনতাইকারী সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। কখনো কখনো এসব চুরি-ছিনতাইয়ের সঙ্গে পরিবহন-সংশ্লিষ্টরাও জড়িত থাকেন। সবাই না, তবে কেউ কেউ থাকেন বলে শুনতে পাই। অনেক কাউন্টার থেকে আবার অপরিচিত লোকের দেওয়া খাবার না খেতেও বলে দেয়। এখানে যাত্রীদের সচেতন থাকতে হবে। তাহলে যদি এড়ানো যায়।

রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে বসবাস করেন শফিক আলী (ছদ্মনাম)। তিনি একটি ছিনতাই চক্রের সদস্য। তিনি বলেন, ‘অজ্ঞান করে ছিনতাই করাটা এখন বেড়েছে। আমরা আগে দৌড় দিয়ে পালাতাম। কিন্তু পাবলিক ও পুলিশের জন্য অনেক সময় ধরা পড়ে যেতে হয়। তাই এখন লোক টার্গেট করে লংপথে ছিনতাই করি। মেডিসিন দিয়ে অজ্ঞান করে ছিনতাই করলে তো ঝামেলা কম। কাজ শেষে নেমে যাওয়া। তবে সুযোগ পেলে জোর করেও ছিনতাই করি আমরা। বেশি সুযোগ পেলে দ্রুত ছিনতাই করে দৌড় মারি। এগুলো মূলত কমলাপুর বাসস্ট্যান্ড, গাবতলী, মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন ও ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ডে করি। তবে তখন পাশে আমাদের লোক রাখা থাকে। বিপদে পড়লে তারাই বের করে নিয়ে আসে।’

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে অনেকে মারা যেতে পারেন। বিশেষ করে কারো যদি লিভারের সমস্যা থাকে, তার ক্ষেত্রে বেঁচে ফেরাটা বেশ কঠিন। আর জ্ঞান ফিরলে খুব একটা সমস্যা হয় না। এ ছাড়া ঘুমের ওষুধও কিন্তু খাওয়ানো হয়। যাত্রীদের খুবই সচেতন থাকতে হবে। রাস্তার দোকান থেকেও পানি কেনা যাবে না। বাসা থেকে নিয়ে যেতে হবে। কারণ, এসব চক্রের সঙ্গে দোকানদারদেরও যোগাযোগ থাকতে পারে।