‘শ্রমিকরা বড় ভূমিকরা রাখলেও ফল শ্রমিকের পক্ষে আসেনি’
ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি সহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, ‘১৯৬৯ সালের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং ১৯৮৪ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকরা বড় ভূমিকা রাখলেও ফলাফল শ্রমিকের পক্ষে আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো অনেক শক্তিশালী ছিল। ৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি সফল করার জন্য আদমজী, ডেমরা থেকে লাখে লাখে শ্রমিক বেরিয়ে এসেছিল। ছাত্রদের শক্তিকে পূর্ণতা দিয়েছিল শ্রমিকের শক্তি। এই অভ্যূত্থানের ভেতর দিয়েই অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতার পথ। অভ্যূত্থানে বিজয় এসেছে, স্বাধীনতা এসেছে কিন্তু শ্রমিকের মুক্তি আসেনি।’
আজ শুক্রবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার ভবনে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির উদ্যোগে প্রবীণ শ্রমিক নেতা ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি সহিদুল্লাহ চৌধুরী ও ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আতিউল ইসলামকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। এ অনুষ্ঠানে ‘শ্রমিক আন্দোলনের একাল সেকাল’ বিষয়ে আলোচনা পর্বে সহিদুল্লাহ চৌধুরী এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, ‘৮৪ সালে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন শ্রমিকরা। গঠিত হয়েছিল স্কপ। ৮৪ সালের ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশে ইতিহাসে নজিরবিহীন শ্রমিক ধর্মঘট পালিত হয়েছে। কিন্তু তখনও শ্রমিকের মুক্তি আসেনি রাজনৈতিকভাবে। শ্রমিকের শক্তি বার বার পথ দেখিয়েছে, কিন্তু বিজয় অর্জন করতে পারেনি।‘’ শ্রমিক নেতা হিসেবে সেই দায় থেকে তিনি নিজেও মুক্ত নন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন সহিদুল্লাহ চৌধুরী।
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারী খাতের পাট শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় পাট খাত খুবই বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। কিন্তু সারা দুনিয়ায় পাটের চাহিদা বাড়ছে, গত অর্থবছরে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা রপ্তানী হয়েছে এ খাত থেকে। পাট শিল্পের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু বিজেএমসির দূর্নীতির কারণে এ খাত ধংসের মুখে পড়েছে। হাজার হাজার শ্রমিকরা ধ্বংসের মুখে পড়েছে। এ শিল্পের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ভেতর দিয়েই শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এর সমাধান হওয়া সম্ভব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে নির্মিত হওয়ার পেছনে এবং সমাজ হিসেবে আজ পর্যন্ত আমাদের যা কিছু অগ্রগতি হয়েছে তার পেছনে আছে শ্রমিকের শ্রম, সংগ্রাম এবং সর্বোপরি শ্রমিক আন্দোলন যা বিভিন্ন পর্বে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ ঠিক করে দিয়েছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান রাজনৈতিকভাবে পরিণতি লাভ করেছে ৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। কিন্তু এই গণঅভ্যূত্থানের মূল শক্তি এসেছে শ্রমিকের অংশ্রগ্রহণের ভেতর দিয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি বদ্ধকূপে পরিণত হয়েছে। এই দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার পথ তৈরি করে দিতে পারে তীব্র শ্রমিক আন্দোলন। প্রবীণদের অভিজ্ঞতার সার নিয়ে নতুরা এ পথে এগিয়ে যাবে, নির্মাণ করবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।’
ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আতিউল ইসলাম তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘স্বাধীনতার আগের সময়ে জুট মিল এবং জুটপ্রেস শ্রমিকরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন যশোর, খুলনা বা নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে। এই আন্দোলন যেমন শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবি দাওয়া নিয়ে সংগঠিত হয়েছে আবার জাতীয় আন্দোলনের পথ নির্মাণ করেছে।এইকালে এসে শ্রমিক দ্বিধা বিভক্ত হয়েছে। শ্রমিক সংগঠনকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনীতির লেজুড় হিসেবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু যারা এই প্রবৃদ্ধির মূল কারিগর সেই শ্রমিকরা এর সুফল পাচ্ছেন না। জাতীয় আয়ের ৮০ ভাগ ভোগ করছেন ১০ ভাগ ধনিক ও মালিক শ্রেণি আর ২০ ভাগ ভোগ করছে ৯০ ভাগ শ্রমজীবী মানুষ। বর্তমান সময়ে চার লক্ষ কোটি টাকার অধিক অর্থের বাজেট হচ্ছে। এই উন্নয়নের অংশ মূল কারিগর গার্মেন্ট শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক ও কৃষি উৎপাদনে জড়িতদের মধ্যে সরাসরি বণ্টন করতে হবে।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রবীণ শ্রমিক নেতা সহিদুল্লাহ চৌধুরী এবং শাহ আতিউল ইসলামের জীবন ও কাজের ওপর পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন তাসলিমা আখ্তার। এরপর শ্রমিক নেতাদের হাতে সম্মাননা স্মারক ও আলোকচিত্র তুলে দেন ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন গণসংতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক জুলহাসনাইন বাবু।