গাড়িচালকের মৃত্যু নিয়ে রহস্য, পুলিশ-পরিবার মুখোমুখি
আমিনুল ইসলাম আমিন (৩০) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্লবী থানার গাড়িচালক। আমিনের মৃত্যুকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
পুলিশ বলছে, গত রোববার সকাল ১০টা ৪৪ মিনিটে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ঝুটপট্টির ক্যাফে নব্য নামের একটি রেস্তোরাঁর সামনে আমিন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি নিহত হন। তবে পুলিশের দাবি মানতে নারাজ ভুক্তভোগীর পরিবার।
নিহতের পরিবার বলছে, মিরপুরের ঝুটপট্টির ঘটনাস্থলে গিয়ে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেও তারা সড়ক দুর্ঘটনার কোনো প্রমাণ পাননি। এমনকি কীভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই তথ্যও কেউ দিতে পারেনি। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু না হলেও সড়ক দুর্ঘটনার কথা জানিয়ে মামলা করতে বারবার বলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করছে ভুক্তভোগী পরিবার।
পুলিশের দাবি অনুযায়ী, ঘটনার সূত্র ধরে মিরপুরের ঝুটপট্টির ঘটনাস্থলে গিয়ে রোববারের ওই ঘটনার তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতে কেউ চোখে দেখেনি। তবে কিছু মানুষকে জড়ো হতে দেখেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এ ছাড়া রোববার সকাল ১০টা ৪৪ মিনিটের ক্যাফে নব্য এবং ফাস্ট লেডি বেনারসি শাড়ির দোকানের সিসিটিভির ফুটেজ ঘেটে দেখা যায়, চলতে চলতে একটি প্রাইভেটকার থেমে গেছে রাস্তায় ওপর। বিপরীত দিকের একটি মাইক্রোবাস স্বাভাবিক গতিতে চলে যাচ্ছে। তখন রাস্তার এক প্রান্ত থেকে দুজন মানুষকে দৌড়াতে দেখা গেছে। কিন্তু দুর্ঘটনার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ছবি বা ভিডিও দেখা যায়নি।
মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধের বি ব্লকে নিজেদের বাড়ি আছে আমিনুল ইসলাম আমিনের। এক ছেলে, এক মেয়ে, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সেখানে গেলে প্রতিবেশী অনেককে জড়ো হতে দেখা যায়। এদের ভেতরে অনেকেই এই মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলেন।
নিহত আমিনের ছোট ভাই মোমিন, মামাতো ভাই আজিজুর ও শাশুড়ি হাজেরা বেগম এনটিভি অনলাইনকে জানান, পুলিশ এখন পর্যন্ত তিনটি স্থানের কথা বলেছে, যেখানে আমিন মারা গেছে। তিনটি স্থানের কোথাও তাঁর মৃত্যুর ঘটনার প্রমাণ পায়নি পরিবার। এমনকি কেউ বলতেও পারছে না কীভাবে আর কখন এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ঘটনাস্থল দেখতে কয়েকবার পুলিশকে অনুরোধ করে নিহতের পরিবার। তবে পুলিশ তাদের ঘটনাস্থলে নিতে চায়নি। বরং পুলিশ ভুক্তভোগীর পরিবারকে সড়ক দুর্ঘটনার মামলা দিতে বলেছে আগে। মামলা দেওয়ার আগে ঘটনাস্থল দেখাবে না পুলিশ।
নিহত আমিনের স্ত্রী কল্পনা রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘পুলিশ আমাকে বলেছিল মিরপুরের ঝুটপট্টির ক্যাফে নব্য নামের একটি রেস্তোরাঁর সামনে এই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। পরে আমি একা আশপাশের বহু দোকানে গিয়েছি। কেউ জানে না এক্সিডেন্ট হয়েছে। ১২ জন দোকানদারের কথা ভিডিও করেছি। তাঁরা বলেছেন, তাঁরা কিছু জানেন না। আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। আজ পুলিশের সঙ্গে ঝুটপট্টিতে গেলাম, অনেক দোকানে গেলাম। কিন্তু তেমন কোনো প্রমাণ তো পেলাম না। প্রমাণ না পেলে কার বিরুদ্ধে মামলা দেব? ভিডিওতে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অথচ পুলিশ দেখতে পাচ্ছে এক্সিডেন্ট! মামলা দেব না। পারলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করুক।’
মৃত্যুর আগেই মর্গে
কল্পনা বলেন, ‘রোববার আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে পল্লবী থানার এসআই সোহেল আমাকে বলেছিলেন, আমিনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। কিন্তু সেখানে তাঁকে নেওয়া হয়নি। দুপুর ২টার দিকে আমিনকে মর্গে দেখেছি। মর্গে গিয়ে দেখি আমিনের হাত-পা নড়ছে। কান পেতে শুনি শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। তখন ডাক্তারদের জানালে তারা আমার স্বামীকে এখানে আনার কাগজপত্র দেখতে চান। তখন এসআই সোহেলকে ফোন দিলে তিনি ধরেননি। কাগজ না দেখানোর ফলে ডাক্তাররা চিকিৎসা দিতে চাননি। তখন আমিনকে জোর করে মর্গ থেকে আমরা বের করে নিয়ে আসি। সে সময় হাসপাতালের লোকজন আমাদের মার দিয়ে বের করে দিয়ে আমিনকে আবার মর্গে ঢুকিয়ে ফেলে।’
এদিকে আমিনের খালাতো ভাই আজিজুল ইসলাম রনি দাবি করেন, ঝুটপট্টি এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোন্দলের জেরে খুন হয়ে থাকতে পারেন আমিন। ঝুটপট্টির কয়েকজন এ কথা তাঁকে জানিয়েছেন।
মিরপুরের ঝুটপট্টির ঘটনাস্থলে গিয়ে কমপক্ষে ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে এনটিভি অনলাইন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববারের ঘটনা নিয়ে স্থানীয় লোকজন বিব্রত। কারণ তারা চায় না পরের ঝামেলা ঘরে আনতে! এই ঘটনা ঘটার পর থেকে পুলিশ কয়েক দফায় গিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছে। এই ঘটনায় কেউ মুখ খুলতে চাইছে না।
তবে এদের ভেতরে একজন নাম প্রকাশ না করতে চেয়ে বলেছেন, ‘হঠাৎ করে একটু হইচই শোনা গেল। গিয়ে দেখি রাস্তায় একজন শুয়ে আছেন। তাঁর মাথা দিয়ে হালকা রক্ত ঝরছিল। কোনো গাড়ি থেকে তাঁকে ফেলে দেওয়া হয়েছে না কি তিনি আসলেই এক্সিডেন্ট করেছেন— সেটা আমি জানি না।’
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে এসআই সোহেল শিকদার বলেন, ‘সিসিটিভির ফুটেজ তো দেখলেন। এর বাইরে আমার কিছু বলার নেই। এখানে লুকানোর কিছু নেই। রোববার আমরা টহলে গিয়ে ১০ নম্বর মেইন রোডের এক পাশে গাড়ি রাখি। কিছু সময় পর ড্রাইভার আমিন আমাকে বলে ওয়াশরুমে গিয়েছিল। এরপর তিনি রোড এক্সিডেন্ট করে মারা যান।’
কিন্তু গাড়ি রাখার স্থানে তো ওয়াশরুম ছিল, তবে এত দূরে গেল কেন-এমন প্রশ্নে এসআই সোহেল বলেন, ‘সে তো আমি জানি না। তার মন চেয়েছে সে গেছে।’
জানতে চাইলে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “আমিনের স্ত্রী তো আমার সামনেই কয়েকবার বললেন, ‘স্যার, আমার স্বামী তো এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। যা যা করার দ্রুত করেন।’ তবে আপনাদের সাথে কী বলেছে তা তো আমি জানি না।”
জানতে চাইলে পুলিশের পল্লবী জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) শেখ শামিম বলেন, ‘সিসিটিভির ফুটেজ দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, আমিন এক্সিডেন্ট করেছে। সে যেহেতু পুলিশের ড্রাইভার ছিল, সেহেতু আমি তাঁকে সেমি পুলিশই ভাবব। তার জন্য আমারও খারাপ লাগছে। ওই নারী আমার কাছে সহযোগিতাও চেয়েছেন। দেখি কিছু করা যায় কি না। কিছু টাকাসহ একটা চাকরির ব্যবস্থা করা যায় কি না।’