‘আসামি বাঁচাতে’ গিয়ে পুলিশ এখন হত্যা মামলার আসামি
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। আদালতে করা অভিযোগে বলা হয়েছে, যৌতুকের মামলার এক আসামিকে বাঁচাতে গিয়ে নিরপরাধ এক যুবককে হত্যা করা হয়েছে। এতে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় এক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। আদালতের নির্দেশে মামলাটি এখন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে। পাশাপাশি জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গফরগাঁও উপজেলার পাকাটি গ্রামের নিহত লিটন মিয়ার মা আজুফা খাতুন গত ১২ মে আদালতে হত্যার অভিযোগটি করেছেন। এতে পুলিশের তিন সদস্য, ইউপি মেম্বারসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা হলেন গফরগাঁও থানার তিন উপপরিদর্শক (এসআই) রুবেল, নুর শাহীন ও সুকমল দত্ত, ইউপি মেম্বার মিজানুর রহমান হিরো, শরিফুল ইসলাম, বিল্লাল হোসেন, আসাদুল হক, বাদল, জুয়েল ও লাল মিয়া।
ঘটনাটি তদন্তে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তার সদস্যরা হলেন ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এ নেওয়াজী, গফরগাঁও সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী হায়দার চৌধুরী ও জেলা বিশেষ শাখার পরিদর্শক ডিআইও-ওয়ান মোখলেছুর রহমান। সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে অভিযোগে বলা হয়েছে, সম্প্রতি স্ত্রীর কাছে যৌতুক দাবির এক মামলায় আদালত গফরগাঁও উপজেলার পাকাটি গ্রামের বাসিন্দা সৌদি আরব প্রবাসী কামরুজ্জামান নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। কামরুজ্জামানের স্ত্রী হেনা আক্তার স্বামীর বিরুদ্ধে ওই মামলাটি করেছিলেন।
কামরুজ্জামান ও লিটন একই গ্রামের বাসিন্দা এবং উভয়ের বাবার নাম ময়েজ উদ্দিন। লিটন আগে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতেন। লিটনের এক ভাইও প্রবাসী। পরে তিনি টিউবওয়েল মিস্ত্রির কাজের পাশাপাশি বাড়ি থেকে কৃষিকাজও করতেন।
কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর গত ২৩ এপ্রিল রাতে গফরগাঁও থানা পুলিশের একটি দল লিটনের বাড়িতে অভিযান চালায় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।
লিটনের বাবা ময়েজ উদ্দিন বলেন, ‘পারিবারিক মামলায় সৌদি প্রবাসী কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তাঁর বদলে লিটনকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায় পুলিশ। এতে সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ৯ মে লিটন মারা যান।’
তবে লিটনের বাবার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গফরগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল আহাদ খান। তিনি দাবি করেন, ‘কামরুজ্জামান ও লিটনের বাবার নাম মিলে যাওয়ায় ওই দিন ভুলবশত লিটনের বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। কিন্তু সে সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে লিটন ভীত হয়ে ঘরের চালে উঠে পড়েন। পরে সেখান থেকে পড়ে গিয়ে মূলত আহত হন তিনি। মানবিক কারণেই অচেতন অবস্থায় লিটনকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।’
কিন্তু লিটনের বাবা অভিযোগ করে বলেন, ‘ওই দিন লিটনকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের পর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হিসেবে উল্লেখ করে তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। শুধু তাই নয়, রোগীর নাম হিসেবেও কামরুজ্জামান উল্লেখ করে ভর্তি করা হয়।’
ময়েজ উদ্দিনের অভিযোগ, “কামরুজ্জামানাকে বাঁচাতেই মূলত লিটনকে ফাঁসানো হয়। এতে যুক্ত ছিলেন পুলিশ ও ইউপি মেম্বার। হাসপাতালে ভর্তিতেই শেষ নয়, চিকিৎসাধীন অবস্থাতেও লিটনকে ‘কামরুজ্জামান’ হিসেবে উল্লেখ করে আদালতে প্রতিবেদন দেয় পুলিশ।’’
অন্যদিকে যৌতুক মামলার আসামি কামরুজ্জামানের বাবা ময়জুদ্দিনও সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর ছেলে সৌদি আরবে আছেন। নিহত যুবকের নাম লিটন, কামরুজ্জামান নয়।
লিটনের বোন কুলসুম আক্তার আজ শুক্রবার সকালে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ইউপি মেম্বার হিরো এবং তাদের বাড়ি পাশাপাশি। ইউপি মেম্বার সব সময় তাঁর ভাইয়ের প্রতি শত্রুতা করত। এর জের ধরেই তিনি পুলিশ দিয়ে লিটনকে আটক করেছেন।
জেলা পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ সাংবাদিকদের বলেন, লিটন হত্যার অভিযোগের ঘটনা তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে পুলিশ সদস্য হিসেবেও কেউ ছাড় পাবেন না।