৪৩ বছর ধরে প্রতারণা, অবশেষে ধরা পড়লেন বারেক হাজি
১৯৫৬ সালে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন মো. বারেক সরকার ওরফে বারেক হাজি। ১৮ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালে পাড়ি জমান সৌদি আরব। কিন্তু প্রবাস জীবনে সুবিধা করতে না পেরে দুই বছর পর প্রতারণার কৌশল আয়ত্ব করে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু করেন প্রতারণার ব্যবসা। প্রতারণার জন্য খোলেন আরসিডি নামের একটি কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানের পুরো অর্থ রয়্যাল চিটার ডেভেলপমেন্ট।
অধিক টাকা কামাতে অন্য সব কাজ বাদ দিয়ে পুরোদস্তর প্রতারক বনে যান বারেক। শুরুতে স্বল্প পরিসরে হলেও পরবর্তীতে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় আরডিসির সুসজ্জিত ছোট ছোট গ্রুপ খোলেন তিনি। যাদের কাজই ছিল বিত্তবানদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। ছোট কোনো প্রতারণা করেন না বারেক। ন্যূনতম ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকার প্রতারণা করেন।
প্রতারণার কাজে তার দক্ষতা, কর্ম কৌশল ও পরিকল্পনা অল্প দিনের ভেতরে বারেক হাজিকে এনে দেয় সাফল্য। ক্রমান্বয়ে প্রতারণার সাম্রাজ্য ছড়িয়ে দেন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এভাবে ৪৩ বছরের প্রতারণার ক্যারিয়ারে অন্তত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ এই প্রতারক জীবনে একবারও গ্রেপ্তার হননি বারেক।
আজ রোববার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব ৪-এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির এসব কথা জানান।
মো. বারেক সরকার ওরফে বারেক হাজি (বাঁয়ে গোলচিহ্নিত) ও তার সঙ্গীরা। ছবি : এনটিভি
গত ২ মার্চ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতারক চক্রের ২২ সদস্যকে আটক করে র্যাব। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর দারুসসালাম এলাকা থেকে প্রতারক চক্রের মূলহোতা বারেক হাজিসহ পাঁচজনকে র্যাব-৪ আটক করেছে বলেও জানান চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির।
আটক অন্য চারজন হলেন মো. হাবিবুর রহমান (২৪), মো. জাকির হোসেন (৫৮), মো. আক্তারুজ্জামান (২৮) ও শাহরিয়ার তাসিম (১৯)। আটকের সময় বারেক হাজির কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও দুটি গুলি উদ্ধার করা হয়।
চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির জানান, ৪৩ বছরে নিরবচ্ছিন্ন প্রতারণার মাধ্যম অন্তত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন বারেক হাজি। এ ছাড়া ঢাকা শহরে নিজের নামে ফ্ল্যাট, গাড়ি, গ্রামের বাড়ি কুমিল্লাতে জমি-জমাসহ অঢেল সম্পত্তি মালিক হয়েছেন প্রতারক সম্রাট বারেক।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, বারেক তাঁর প্রতারণা কোম্পানির নাম দেন আরসিডি। যার প্রকৃত রূপ রয়্যাল চিটার ডেভেলপমেন্ট। এ নামে অফিস নেওয়াসহ সব কার্যক্রম চালিয়ে এলেও প্রকৃত নামটি ছিল সবার অজানা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরসিডির ছোট ছোট গ্রুপ রয়েছে। যারা সুসজ্জিত অফিস ভাড়া করে বিত্তবানদের ফাঁদে ফেলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়।
মো. বারেক সরকার ওরফে বারেক হাজি ও তার সঙ্গীদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। ছবি : এনটিভি
যে ধরনের প্রতারণা করতেন বারেক
চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির জানান, বারেক হাজির চক্র ছোটখাট অঙ্কের প্রতারণা করে না। ন্যূনতম ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকার প্রতারণা করে। চক্রটি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবসরের আগে থেকেই টার্গেট করে। এরপর তাদের কোম্পানিতে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে অফিসে নিয়ে আসে এবং প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। অফিস কর্মকর্তাদের চালচলনে অভিভূত হয়ে টার্গেট হওয়া ব্যক্তিরা অবসরকালীন পাওয়া পেনশনের টাকা বিনিয়োগ করতেন। কয়েকদিন পরই অফিসসহ উধাও হয়ে যেতেন অফিসের কর্মকর্তারা।
র্যাব ৪-এর অধিনায়ক জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের কয়েক কোটি টাকার অর্ডারের ফাঁদে ফেলে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার স্যাম্পল নিত বারেকের চক্র। এরপর কয়েক কোটি টাকার মালামাল তৈরিতে যে পরিমাণ কাঁচামাল প্রয়োজন তা সরবরাহের কথা বলে অগ্রিম হিসেবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিত চক্রটি। তারা ইট-পাথর, রড-সিমেন্ট, থাই/অ্যালুমিনিয়াম, গার্মেন্টস, চাল, সোলার প্যানেল ব্যবসায়ী লোকদের টার্গেট করত। তাদের বিপুল অর্থের অর্ডারের ফাঁদে ফেলে এবং অর্ডারের ভুয়া চুক্তিপত্র সম্পন্ন করে অগ্রিম বাবদ টাকা আদায় করে প্রতারণা করত। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের জমি বা নির্মাণাধীন ভবনের ওপর মুঠোফোনের টাওয়ার স্থাপন করার প্রলোভন দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিত। কখনো বিভিন্ন এলাকায় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের বাসায় এবং তার এলাকার মাদ্রাসা, মসজিদে এনজিওর পক্ষ থেকে বিনা খরচে সৌর প্যানেল বসানোর কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত।