‘এটা কিছু না, মান-অভিমান করেছে, ঠিক হয়ে যাবে’
রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে ছাত্রদলের বিদ্রোহী নেতাদের বিক্ষোভ করার ঘটনাকে ‘কিছু না’ বলে মন্তব্য করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এটা (বিক্ষুব্ধ ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের কর্মসূচি) কিছু না। ওরা মান-অভিমান করেছে, এটা ঠিক হয়ে যাবে।’
আজ মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে প্রথমে মির্জা আব্বাস এবং সাড়ে ৫টার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা তালা খুলে দিয়ে তাঁদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেন।
দুই নেতাই তৃতীয় তলায় অবস্থানরত অসুস্থ দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে দেখতে যান এবং চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নেন।
গতকাল সোমবার সকাল থেকে রিজভী আহমেদ অনবরত বমি করতে থাকেন। পরে দলের চিকিৎসকরা তাঁকে স্যালাইন দিয়ে সেখানেই চিকিৎসা শুরু করেন।
মির্জা আব্বাস বিকেল ৫টার দিকে বিএনপি কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। তাঁর সঙ্গে দলের নেতা আবদুস সালাম আজাদ, মীর সরাফত আলী সপু, রফিকুল ইসলাম মজনুও যান। ২৬ মিনিট পর বেরিয়ে এসে মির্জা আব্বাস সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
আপনি দলের নীতিনির্ধারকদের একজন, বিক্ষুব্ধরা দাবি জানাচ্ছে সেগুলো কি মানা হবে- এমন প্রশ্ন করা হলে মির্জা আব্বাস বলেন, বিষয়টা সাংবাদিকরা যেভাবে সিরিয়াসলি নিয়েছে বা উপস্থাপন করেছে আসলে বিষয়টি সেই রকম সিরিয়াস না। এটা পোলাপানের কাজ-কর্ম, মান-অভিমানের কাজ।
মির্জা আব্বাস বলেন, কয়েকদিন আগে ঈদ গেছে। মান-অভিমান হয়েছে। এটা ঠিক হয়ে যাবে। কারো কিছু করতে হবে না। কোনো সালিশ, আলোচনা কিছুই করতে হবে না। ওরা রাগ করেছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সাংবাদিকদের বলেন, এটা কোনো পরিস্থিতি না যদি আপনারা ফলাও করে প্রচার না করেন। কেউ ব্যথা পেলে চিৎকার দেয়-এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দীর্ঘদিন দলের কতগুলো পদ্ধতিগত কারণে অথবা নিয়মিত কাউন্সিল না হওয়ায় যোগ্য ছেলেরা তাদের আরাধ্য লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নাই। সেই বিষয়টা আমাদের বিবেচনা করতে হবে। এরা দলের জন্য পরিশ্রম করে, এরা বাইরের নয়, এরা দলের মঙ্গল চায়।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, দলের মঙ্গল এবং ওদেরও যতটুকু প্রাপ্যটা আছে, তা সমাধান করার পথ আমাদের খুঁজতে হবে। এটা অনেক বড় দল, অনেক কর্মী, অনেক নেতা। আমরা বিরোধী দলে আছি, আমাদের সীমাবদ্ধতাও আছে। এই সীমাবদ্ধতার মূল কারণটা হলো আমাদের নিয়মিত কাউন্সিল হয় নাই। মামলা-হামলা-নির্যাতনের কারণে নিয়মিত এই সাংগঠনিক কাজগুলো হয়নি। এই নিয়মিত সাংগঠনিক কাজগুলো হলে ওরাও ছাত্রদল করার জন্য এত আগ্রহী হতো না। ওরাও বুঝে এটা।
সমাধান কী দেখছেন প্রশ্ন করা হলে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সমস্যা যেমন আছে, সমাধানও আছে। আলোচনার মাধ্যমে এটার সমাধান হবে।
রুহুল কবির রিজভী কেমন আছেন জানতে চাইলে গয়েশ্বর বলেন, তিনি (রিজভী) অসুস্থ। তাঁকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। ডাক্তার সেখানে আছে।
রিজভী আহমেদ হাসপাতালে যাবেন কি না, প্রশ্ন করা হলে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এটা চিকিৎসকরা ঠিক করবেন। কিন্তু কোনো পরিস্থিতি বা এই ঘটনার জন্য তাঁকে বাইরে( হাসপাতাল) যেতে হবে-এটা যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন না।
বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই নেতা অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও বিক্ষুব্ধরা অফিসের সামনেই অবস্থান নিয়ে ছিলেন। কার্যালয়ের প্রধান গেটে তালা লাগানো ছিল।
এর আগে আজ সকাল ১০টা থেকে ছাত্রদলের সাবেক কমিটির নেতাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে দেখা যায়। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতরে রিজভীকে রেখেই বেলা সোয়া ১১টার দিকে কার্যালয়ের মূল দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। পরে ১১টা ২০ মিনিটে কার্যালয়ের সামনে আসেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুর হক মিলন, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী এবং প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশারফ হোসেন।
বিএনপির এই চার নেতা কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে তাঁদের বাধা দেন সাবেক ছাত্রনেতারা। এ সময় তাঁদের সঙ্গে কমিটির বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়।
ছাত্রনেতারা বিএনপির চার নেতাকে বলেন, বয়সসীমা বেঁধে না দিয়ে ছাত্রদলের ধারাবাহিক কমিটি দিতে হবে। আর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একাই দুটি পদ নিয়ে অফিসকেই বাড়িঘর বানিয়েছেন। রিজভীকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যান।
এ সময় শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী কার্যালয়ের ভেতরে গিয়ে কথা বলার অনুরোধ করেন। তবে ছাত্রনেতারা বলেন, ‘ভেতরে নয়, এখানেই কথা বলুন।’
পরে বরকত উল্লাহ বুলু কার্যালয়ের সামনে থেকে চলে যান। আর মিলন, এ্যানী ও মোশাররফ কার্যালয়ের পাশে বইয়ের দোকানে বসতে চাইলে দোকানের শাটার নামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর এ্যানী ছাত্রনেতাদের ধমক দিলে এক নেতা তাঁকে ধাক্কা দেন।
ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক শেষে ফজলুল হক মিলন সাংবাদিকদের বলেন, ‘কমিটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দল থেকে দেওয়া হয়েছে। আর আমরা সবাই বসে এটা কার্যকর করব। তবে দুঃখ ও অভিমান থাকতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা না। আমরা তাদের দুঃখ ও বেদনা শুনব। সেটা আমরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বলব।’
বিক্ষোভের একপর্যায়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেন। কয়েক ঘণ্টা পর আবার বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করা হয়।
মঙ্গলবার বিকেল ৪টার পর ছাত্রদলের বিদ্রোহীরা কার্যালয়ের মূল দরজার তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। কিছু সময় পর ভেতর থেকে ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর পূর্বের সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল ইসলাম নয়নের অনুসারীদের বের করে আনতে দেখা যায়। এ সময় বাইরে থাকা নেতাকর্মীরা তাদের কিল ঘুষি লাথি মারেন। সর্বশেষ নয়নকে বের করা আনা হয়। গেটের সামনে বিক্ষুব্ধরা নয়নকেও কিল-ঘুষি মারতে থাকেন। পরে ছাত্রদলেরই কয়েকজন তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশাতে তুলে দেন।
বিক্ষুব্ধরা জানান, নয়ন তাঁর দলবল নিয়ে সকাল থেকে কার্যালয়ে অবস্থানরত দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে পাহাড়া দিচ্ছিলেন। তাই তাঁকে বের করে দেওয়া হলো।
ছাত্রদলের বিদায়ী কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মোক্তার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, কার্যালয়কে নিজের ঘরবাড়ি বানিয়ে রাখা জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী হঠাৎ করে কমিটি বিলুপ্ত করেন। তিনি দলীয় কার্যালয়কে নিজ বাসভবন বানিয়ে রেখেছেন। আমরা বলেছি, উনি যেন সম্মানের সঙ্গে এখান থেকে বের হয়ে যান।
কার্যালয়ের ভেতরে থাকা কয়েকজন জানিয়েছেন, বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রিজভীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা চলছে। রিজভী যদি সম্মানের সঙ্গে বের না হন, তাহলে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নামানো হবে- এমন হুমকি দিয়েছেন ছাত্রদলের সাবেকরা।
বিলুপ্ত কমিটির সহসভাপতি মামুন বিল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের যেসব দাবি আছে সেগুলো আমরা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর একটি দাবিনামা দিয়েছিলাম। তা বাস্তবায়ন না করে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী হঠাৎ কমিটি বাতিল করেছেন। তিনি ছাত্রদলের কমিটিতে থাকার জন্য ৩৫ বছর বয়স নির্ধারণ করেছেন, এটা বাতিল করতে হবে।
মামুন বিল্লাহ বলেন, রিজভী ভাই যদি না নামেন তাহলে আমরা তালা ভেঙে উপরে উঠব। আর যদি রিজভী ভাই নিচে নেমে যান এবং তাঁকে যদি আইসিইউতে ভর্তি করতে হয় সেই খরচ আমি দেব। আমি সামনে অ্যাম্বুলেন্স এনে রাখলাম। তবু নোংরা রাজনীতি করতে দেব না।
জানা যায়, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা চলছে। বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা বাইরে থাকা নেতাদের।
মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় গত ৩ জুন রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বাতিল করা হয়। আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে সংগঠনটির নতুন কেন্দ্রীয় সংসদ গঠন করার কথা বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
ছাত্রদলের অনুষ্ঠিতব্য কাউন্সিলে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতার বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ছাত্রদলের প্রাথমিক সদস্য হতে হবে। অবশ্যই বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র হতে হবে। কেবল ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী সময়ে যেকোনো বছরে এসএসসি অথবা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
তবে সংগঠনটির সাবেক নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ছাত্রদলের কমিটি গঠনে বয়সের কোনো সীমারেখা নির্ধারণ না করে স্বল্প মেয়াদে আগামী ১ জানুয়ারি পর্যন্ত একটি কমিটি গঠন এবং পরের কমিটিকেও এক বছরের স্বল্প মেয়াদে গঠন করে ছাত্রদলের নেতৃত্বের জট কমানোর দাবি করেছেন। কিন্তু বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাদের সেই দাবি অগ্রাহ্য করে নানান শর্ত জুড়ে দিয়েছেন।
তাদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পছন্দের নেতাকে সামনে আনার জন্য তারা এ ধরনের শর্ত দিয়েছেন।