ডেঙ্গু : ঠাঁই নেই রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে
চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার বিঙ্গুলিয়া গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্রী নিপা আক্তার। এক সপ্তাহ আগে জ্বরে আক্রান্ত হলে বড় ভাই সেলিম মিয়া তাকে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার চিকিৎসকরা নিপা আক্তারকে ঢাকায় কোনো হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। ঢাকায় এনে সেলিম মিয়া বোনকে তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত তাদের ঠাঁই হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সিঁড়িতে। একই সিঁড়িতে নিপা আক্তার মতো আরো রোগী রয়েছে। তারাও ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা নিচ্ছে।
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা নুরুল আলমের দুই বছরের ছেলের জ্বর হয়। রক্ত পরীক্ষার পর শিশুটির ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ঢাকার বেশ কয়েকটি হাসপাতালে গিয়ে কোনো সিট খালি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত শিশুটিকে বাসাবো এলাকার একটি ক্লিনিকে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
নুরুল আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ডেঙ্গু জ্বরে আমার সন্তানটি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাগলের মতো এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দোঁড়াদৌঁড়ি করে কোথাও ভর্তি করাতে না পেরে এলাকারই একটি ক্লিনিকে ভর্তি করেছি।’
এখানেও কোনো সিট খালি ছিলো না। শেষ পর্যন্ত নার্সদের থাকার জায়গায় তাকে সিট করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান নুরুল আলম।
প্রতিদিনই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে হাসপাতালগুলোতেও রোগীর বাড়তি চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। সরকারি হাসপাতালে আসনের চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি করানোর সুযোগ থাকলেও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে এ সুযোগ কম। ফলে রোগীরা ঢাকা মেডিকেলসহ সরকারি হাসপাতালে ছুটছেন।
ঢাকা মেডিকিলের মেডিসিন বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, নির্ধারিত সিটগুলোর বাইরেও বারান্দায়, সিঁড়িতে, লিফটের সামনে অনেক রোগী রয়েছে। চিকিৎসকরা তাঁদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। ঢাকার কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে একই চিত্র দেখা গেছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হতে পারলেও চিকিৎসাসেবা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রোগীর স্বজনদের। চিকিৎসক লিখে দিয়েছেন জরুরিভিত্তিতে স্যালাইন পুশ করতে। রোগীদের ভিড়ে চার ঘণ্টায়ও সেই ‘জরুরি স্যালাইন’ দেওয়া হয়নি, এমন অভিযোগ চাঁদপুর থেকে আসা সেলিম মিয়ার। নার্স ও ওয়ার্ডবয়দের সঙ্গে রোগীদের স্বজনদের ঝগড়া ও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে কোথাও কোথাও।
মগবাজার ইনসাফ বারাকা কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের কর্মকর্তা সোহরাব আকন্দ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘গত ১০ দিন ধরে আমাদের হাসপাতালে কোনো সিট খালি নেই। একটি সিট খালি হলেই কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাতজন রোগীর সিরিয়াল তৈরি থাকে। আমাদের এখানে সিটের বাইরে রোগী ভর্তি করার সুযোগ নেই। তাই তাদের অন্য হাসপাতালে চলে যেতে অনুরোধ করি।’
সোহরাব আকন্দ আরো বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের সাত-আটজন কর্মীর নিকটাত্মীয়ও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এখানে ভর্তি হতে এসেছিলেন। এরমধ্যে তিনজনের আত্মীয়কে ভর্তি করে এখানে চিকিৎসা দিতে পেরেছি। অন্যদের অন্যান্য হাসপাতালে নিতে হয়েছে।
এবার বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকেই আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী প্রতি ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ৫৬০ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী হাসপাতাগুলোতে ভর্তি হচ্ছেন।
চিকিৎসদের মতে গতবারও ডেঙ্গুতে প্রায় আট হাজার জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। এতে ২৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে। তখন থেকে ডেঙ্গুর ব্যাপারে আরো সচেতন হওয়া জরুরি ছিল। এখন হাইকোর্টের নির্দেশনাতেও মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হচ্ছে না। আগাম প্রস্তুতি থাকলে হয়তো এমন অবস্থা হতো না বলে জানান চিকিৎসকরা।
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ওই হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে পুরুষ রোগীর জন্য সিট আছে মাত্র ৬০টি। এই্ ওয়ার্ডে এখন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাই ১৩২ জন। সব ধরনের রোগী মিলে এ পুরুষ ওয়ার্ডটিতে এখন ৩৫০ জন রোগী ভর্তি আছেন।
রাজধানীর আদ-দ্বীন হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জরুরি চিকিৎসার জন্য কয়েকটি ওয়ার্ডকে খালি করে দেওয়া হয়েছে। এখানেও অতিরিক্ত রোগীর চাপে হাসপাতালের ত্রাহি অবস্থা। মেঝেতে রোগী, নামাজের জায়গায়, বারান্দায় এমনকি ওপরে উঠার সিঁড়িতেও রোগীদের বিছানা করে দেওয়া হয়েছে।