পাবনার গো-খামারিদের মধ্যে হাহাকার
দেশের অন্যতম দুগ্ধ উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে পরিচিত পাবনার খামারিদের মধ্যে হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। ১৪টি কোম্পানির পাস্তুরিত তরল দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনায় পাবনায় খামারিদের কাছ থেকে দুগ্ধ সংগ্রহ বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে চরম বিপাকে পড়েছে বৃহত্তর পাবনার লক্ষাধিক গো-খামারিরা।
আজ সোমবার সকাল থেকে কোথাও দুধ বিক্রি করতে না পেরে হতাশায় ভাঙ্গুড়া বাজারে প্রায় ৫০০ লিটার দুধ রাস্তায় ঢেলে প্রতিবাদ জানিয়েছে তারা।
বিক্ষুব্ধ খামারিরা জানান, বৃহত্তর পাবনার ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া ও সাঁথিয়া ও সুজানগর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়াসহ আশপাশের উপজেলার ১৫ হাজার দুগ্ধ খামার থেকে প্রতিদিন আড়াই লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয়, যা রাষ্ট্রায়ত্ত মিল্কভিটাসহ চারটি কোম্পানিতে সরবরাহ করা হতো। হাইকোর্টের নির্দেশনায় এসব কোম্পানির উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্তে দুগ্ধ সংগ্রহ বন্ধ থাকায় ১০ থেকে ১২ টাকা দরে বিক্রি করেও মিলছে না ক্রেতা। বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা এসব দুগ্ধ খামারিরা পড়েছে চরম দুশ্চিন্তায়। ক্ষুদ্র খামারিদের উৎপাদিত দুধ বিক্রিতে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেছে তারা।
পাবনার ভাঙ্গুড়া পৌরসভার মেয়র ও দুগ্ধখামারি গোলাম হাসনায়েন রাসেল জানান, ভাঙ্গুড়া ও আশপাশের এলাকা থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত মিল্কভিটা ছাড়াও প্রাণ, আকিজ ও ব্র্যাক ডেইরি অর্ধশতাধিক সংগ্রহ কেন্দ্রে দুধ সংগ্রহ করে। প্রতিদিন কেবল ভাঙ্গুড়াতেই প্রায় ৬০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। কিন্তু, হাইকোর্টের নির্দেশনার পর কোনো কোম্পানিই আর খামারিদের কাছ থেকে দুধ নিচ্ছে না। মিষ্টির দোকান, বেকারিসহ খুচরা বাজারে ১০ টাকা লিটার দরেও দুধ বিক্রি করা যাচ্ছে না। এই অবস্থা কয়েকদিন চললেই এ অঞ্চলের দুগ্ধ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।
ফরিদপুর উপজেলার রতনপুর গ্রামের নারী খামারি মর্জিনা খাতুন বলেন, প্রতিদিন তাঁর গো-খামারে ১০০ লিটার দুধ হয়। সোমবার সকালে ও বিকেলে দুধ দোহানোর পর সব দুধ ফেলে দিতে হয়েছে। এখন তাঁদের মাথায় হাত।
ভাঙ্গুড়া উপজেলার পাথরঘাটা গ্রামের গোখামারি আলী আক্কাস হারুন জানান, ব্যাংক থেকে চার লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তিনি আটটি গরু নিয়ে খামার করেছেন। দুই মাস ধরে ক্রমাগত লোকসানে দুটি গরু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। সোমবার সকাল থেকে প্রায় ৩০ লিটার দুধ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ধরনা দিয়েও বিক্রি করতে পারেননি। ক্ষোভে দুঃখে দুপুরে ভাঙ্গুড়া বাজারে সব দুধ রাস্তায় ঢেলে দিয়েছেন।
একই গ্রামের গোখামারি আবু সাইদ জানান, প্রতি কেজি খইলের দাম সর্বনিম্ন ৫০ টাকা। এখন পাঁচ লিটার দুধ বিক্রি করেও এক কেজি খইল কেনা যাচ্ছে না।
মিল্কভিটার ভাঙ্গুড়া উপজেলার শরৎনগর দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. আশরাফ আলী জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সোমবার থেকে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের সব কেন্দ্রে দুধ সংগ্রহ বন্ধ রয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত কোনো খামারির দুধ কেনা হবে না।
পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ জানান, দুগ্ধ খামারিদের আকস্মিক সংকটের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সরকার তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের নিয়ে এ সংকট মোকাবিলায় দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে সোমবার সকালে পাবনার ভাঙ্গুড়ায় ব্র্যাক, মিল্কভিটা, প্রাণ ও আকিজসহ দুগ্ধ ক্রয় কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রাখার প্রতিবাদে দুগ্ধ সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপকরা ভাঙ্গুড়া বাসস্ট্যান্ডে মানববন্ধন করেছেন।
সোমবার দুপুরে সমিতির নেতা পাথরঘাটা গ্রামের হারুনর রশিদ বলেন, এ উপজেলায় প্রতিদিন ২০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। অথচ কোনো কোম্পানিই দুধ কিনছে না। তাই আমরা খামারিদের দুধ নিয়ে মহাবিপদে পড়েছি। একই সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।
এলাকার খামারিরা জানান, ব্র্যাক চিলিং সেন্টারে ভেজাল দুধ কেনা হতো বলে অভিযোগ ওঠায় কিছুদিন আগে থেকে এখানে দুধ কেনা বন্ধ রয়েছে। এলাকাবাসী বিশেষ ব্যবস্থায় বিশুদ্ধ দুধগুলো কিনতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে বিএসটিআইয়ের লাইসেন্সধারী ১৪ কোম্পানির মধ্যে শুধু মিল্কভিটার পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি করতে পারবে বলে আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত।
মিল্কভিটার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ সোমবার হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি শেষে চেম্বার বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ননী এ আদেশ দেন।
আদালত আদেশে বলেছেন, ‘মিল্কভিটার সব পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সংগ্রহ ও বিপণন সরবরাহ বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত।’
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আদালতে বিএসটিআইর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার সরকার এম আর হাসান। মিল্ক ভিটার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মহিউদ্দিন হানিফ।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, হাইকোর্ট বিভাগ আদেশ দিয়েছিলেন সব রকম বিক্রয় বিপণন বন্ধ থাকবে। তার বিরুদ্ধে মিল্কভিটার পক্ষে আমি আপিল বিভাগে গিয়েছিলাম। আপিল বিভাগ এ আদেশের কার্যকারিতা আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছেন। এ জন্য আদেশটি শুধু মিল্কভিটার জন্য প্রযোজ্য হবে। মিল্কভিটার পাস্তুরিত দুধ বাজারজাত করতে বাধা নেই।
এর আগে গতকাল রোববার মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান থাকায় বিএসটিআইয়ের লাইসেন্সধারী ১৪টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি পাঁচ সপ্তাহের জন্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
লাইসেন্সধারী সব ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধে অ্যান্টিবায়োটিক ও ডিটারজেন্টসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান আছে কি না, সে বিষয়ে চারটি প্রতিষ্ঠানের ল্যাবের পরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে শুনানি শেষে আদালত এ আদেশ দেন।