ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন ব্যারিস্টার সুমন
ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন।
আজ বুধবার বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালতে দুপুর ২টায় হাজির হয়ে ব্যারিস্টার সুমন সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যে তিনি বলেন, সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন পুলিশ বিভাগের বড় একজন কর্মকর্তা ছিলেন। সোনাগাজী থানায় কর্মরত থাকা অবস্থায় গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহান রাফির সঙ্গে অধ্যক্ষের শ্লীলতাহানির অভিযোগের কথোপকথন রেকর্ড করেন। মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাত ও শিক্ষককে সোনাগাজী থানায় নিয়ে এসে নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে আইন বর্হিভূতভাবে তার ভিডিও ধারণ করেন। এরপর ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হলে গত ১১ এপ্রিল সকালে ইউটিউবে ভিডিওটি দেখতে পান। মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করার নামে জেরা করতে করতে আপত্তি, মানহানিকর প্রশ্ন করতে থাকেন। এমনকি তার নাম ও ভিডিও প্রকাশ করা হয়।
সুমন সাক্ষ্যে বলেন, গত ৬ এপ্রিল নুসরাতকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য জোর করলে তিনি তা অস্বীকার করেন। এরপর চার-পাঁচজন মুখোশ পরা মানুষ নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই দিনই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। তার মৃত্যুর সাথে সাথে আসামি কর্তৃক ধারণকৃত ভিডিওটি প্রকাশের পর সমাজে অস্থিরতা তৈরি হয়। এতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা ঘটে। আমি ভিডিওটি দেখার পর বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে এ ঘটনার বিচার হওয়ার দরকার মনে করি মামলাটি দায়ের করি।
এর পরে ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ ব্যারিস্টার সুমনকে জেরা শুরু করেন। জেরায় তিনি সুমনকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি আপনার মামলার আরজিতে আপনার স্থায়ী ঠিকানা দিয়েছেন?
জবাবে সুমন বলেন, না, আমি স্থায়ী ঠিকানা দেই নাই।
এরপরে আইনজীবী আবার প্রশ্ন করে বলেন, আপনি কি মামলার আগে বিচারক থেকে মামলা দায়েরের অনুমতি নিয়েছেন?
জবাবে সুমন বলেন, না, অনুমতি নেই নাই।
আবার আইনজীবী প্রশ্ন করেন, আপনি কি মামলার আগে নুসরাতের পরিবারের থেকে অনুমতি নিয়েছেন?
জবাবে সুমন বলেন, না, নেই নাই।
আইনজীবী প্রশ্ন করে বলেন, মামলা করার আগে আগে কি আপনি শাহবাগ থানায় মামলা করতে গিয়েছেন?
জবাবে ব্যারিস্টার সুমন ‘না’ বলেন।
এর পরে আইনজীবী আবার প্রশ্ন করে বলেন, আপনি কি শাহবাগ থানায় কোনো সাধারণ ডায়েরি করেছেন?
জবাবে সুমন না বলেন।
এর পরে ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী জেরার সময় চাইলে বিচারক আগামী ২০ আগস্ট পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের নতুন দিন ধার্য করেন।
আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সাক্ষ্য গ্রহণের সময় ওসি মোয়াজ্জেম আদালতের কাঁঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে তাঁকে ফের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়।
গত ২ জুলাই হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। এর আগে ১৭ জুন তাঁর জামিন আবেদন নাকচ করেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল।
এর আগের দিন ১৬ জুন শাহবাগ এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০ জুন সাইবার ট্রাইব্যুনালে ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে কারাগারে ডিভিশন পাওয়ার বিষয়ে আবেদন করা হলে বিচারক ২৪ জুন ওসি মোয়াজ্জেমকে প্রথম শ্রেণির বন্দির (ডিভিশন) সব সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
সোনাগাজী থানায় মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে ‘অসম্মানজনক’ কথা বলায় এবং তাঁর জবানবন্দির ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গত ১৫ এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় করা অভিযোগটি পিটিশন মামলা হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। সেই সঙ্গে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইয়ের ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে তদন্ত করে ৩০ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত ২৭ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন। একই দিন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে একই ট্রাইব্যুনালের বিচারক সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে ১৭ জুন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করেন।
পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বাদীসহ ১৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে সোনাগাজী থানার চারজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।
প্রতিবেদনে পিবিআই বলেছে, নুসরাত জাহান রাফির বয়স কম এবং তিনি একজন মাদ্রাসাছাত্রী। তাকে কয়েকজন পুরুষের সামনে শ্লীলতাহানির বক্তব্য শোনা এবং তা ভিডিওধারণ করা ন্যায়সঙ্গত নয়। নারী ও শিশুরা যেহেতু শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় থানায় আসেন, সেহেতু নারী ও শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ সদস্যদের অনেক বেশি সহনশীল হওয়া প্রয়োজন।
‘ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় অপরাধ করেছেন।’
গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ভুক্তভোগী নুসরাতের মা। পরে সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে যাওয়ার পর সোনাগাজী থানার ওসির কক্ষে ফের হয়রানির শিকার হতে হয় নুসরাতকে। নিয়ম না মেনে জেরা করতে করতেই নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি। মৌখিক অভিযোগ নেওয়ার সময় দুজন পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তাঁর আইনজীবী ছিলেন না।
গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার আগ মুহূর্তে মিথ্যা কথা বলে নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয় দুর্বৃত্তরা। মামলা তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানালে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় তারা। ওই দিন নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে গত ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন নুসরাতের মৃত্যু হয়।