ওষুধ আনতে কত সময় লাগাবেন, আর কত মানুষ মারা গেলে?
ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় মশা নিধনের নতুন ওষুধ দ্রুত সময়ের মধ্যে আমদানির নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করতে বলেছেন আদালত। এছাড়া ডেঙ্গু রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রত্যেক সরকারি হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক মানের একজন চিকিৎসককে ২৪ ঘণ্টা তদারকি এবং হাসপাতালে বেড সংখ্যা বৃদ্ধির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আদালত। এক্ষেত্রে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে হাসপাতালগুলোকে তদারকি করতে বলা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ আজ বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার পর বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি সোহরাওয়ারদীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এসব আদেশ দেন।
এর আগে এডিস মশা নির্মূলে নতুন ওষুধ আনার বিষয়ে গড়িমসি করায় এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ দুপুর ২টার আগে আদালতে হাজির হন। সকালে তাঁকে তলব করেছিলেন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ।
আদালতে হাজির হওয়ার পর দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। শুনানির শুরুতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা আদালতকে বলেন, মাই লর্ড, সিটি কপোরেশনকে ওষুধ এনে দিলে আমরা ছিটাব। এখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব এসেছেন। তিনি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিবেন।
এরপর সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ আদালতের ডায়াসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেন, স্যার, ডেঙ্গু মশা নিধনে আমরা কঠোর মনিটরিং করছি। দুই সিটি কপোরেশনে অভিযান চালানো হচ্ছে। সব ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে। আমরা গত কয়েকদিনে একাধিক মিটিং করেছি। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা দিন রাত মিটিং করে যাচ্ছি।
এ সময় আদালত বলেন, মিটিং করেন; ওষুধ তো নাই। আপনাদের মিটিং দিয়ে কী হবে?
জবাবে সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ইতোপূর্বে যেসব ওষুধ আনা হয়েছে তা দিয়ে নিধন চলছে। আমরা মিটিং করে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছি।
এ সময় আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আপনাকে এখানে আসার পূর্বে কোনো ব্রিফ করা হয়নি? পুরান ওষুধ তো অকার্যকর। নতুন ওষুধ কবে আনবেন?
জবাবে সচিব বলেন, ওষুধ আনার জন্য আমরা দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে মিটিং করেছি। নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
এ সময় আদালত বলেন, আপনাকে এখানে (হাইকোর্টে) ডাকা হয়েছে নতুন ওষুধ কি আপনারা আনবেন নাকি সিটি কপোরেশন? কারণ সিটি কপোরেশন লিখিত আবেদন করেছে যে ওষুধ আনার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। সিটি কপোরেশন শুধু ছিটাবে। আপনি সে বিষয়ে বলেন।
জবাবে সচিব বলেন, স্যার, আমরা সুপাইভাইজ করব। দেশে ডেঙ্গু নিয়ে দুর্ভোগ চলছে। আমরা মিটিং করে বলেছি যত জনবল দরকার হয় আমরা দিব। অর্থ প্রয়োজন হলে আমরা বাজেট দিচ্ছি।
আদালত আবারো সচিবের উদ্দেশে বলেন, আপনাকে আমরা যেটা জিজ্ঞাসা করছি সেটার উত্তর দেন। ওষুধ কী আপনারা আনবেন? না সিটি কপোরেশন আনবে?
জবাবে সচিব বলেন, সিটি কপোরেশন স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। তারা জনবল, অর্থ চাইলে আমরা যোগান দিব।
এ সময় আদালত বলেন, নতুন ওষুধ কোথা থেকে আসবে?
সচিব বলেন, চীন থেকে আনা হয়।
আদালত আবারো জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা বলছেন, ওষুধ আসবে। কবে আসবে? এতদিন আসেনি কেন?
সিটি কপোরেশনের আইনজীবী আদালতকে বলেন, বিশেষ বিমানে আসার কথা; তবে এখনো এসে পৌঁছেনি।
আদালত সচিব হেলালুদ্দীনকে বলেন, জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ আনা দরকার। প্রাইভেটভাবে ওষুধ আনার জন্য অফিসিয়ালি এলসি খুলে আবার পদ্ধতি মেইনটেইন করতে হলে তো অনেক সময় লেগে যাবে। সরকার নিজস্ব প্রসেসে ওষুধ আনার ব্যবস্থা করতে পারে। তারা সরাসরি কি আনতে পারে?
জবাবে সচিব বলেন, ৩১ জুলাই থেকে একযোগে মশক নিধন চলছে।
এ সময় আদালত বলেন, আপনারা দুই সিটি কপোরেশনে অভিযান চালাচ্ছেন। সিটি কপোরেশন যদি ওষুধ আনে ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়ে যেসব ওষুধ দরকার তা কে দেবে? সেখানে কে ওষুধ ছিটাবে? সেগুলো কি দুই সিটি কপোরেশন আনবে?
আদালত আরো বলেন, ওষুধ তো সরকার টু সরকার যোগাযোগ করে দ্রুত সময়ে আনতে পারে। যখন কোনো দেশে দুর্যোগ নেমে আসে তখন তো বিশেষভাবে সবই অনা হয়। বাংলাদেশ টু চীন সরকার সরাসরি যোগাযোগ করে দ্রুত আনার ব্যবস্থা করতে পারেন।
এ সময় সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ আবারো বলেন, আমরা গত ২৮ জুলাই সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিটিং করেছি। এরপর জনবল দিয়েছি।
আদালত বলেন, জনবল দিয়ে কী হবে? আপনার ওষুধ তো নেই। জনবল কি মশা মারতে পারবে? আপনাদের কাছে সিটি কপোরেশন মশার ওষুধ আনার জন্য অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছে। আপনারা এখনো অনুমোদন দেননি।
জবাবে সচিব আবারো বলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমরা মিটিং করেছি।
এ সময় আবারো ক্ষোভ প্রকাশ করে আদালত বলেন, ওষুধ দরকার। জনবল দিয়ে কী হবে? আপনাদের ওষুধ আনতে অসুবিধা কোথায়?
জবাবে সচিব বলেন, আমি তো হঠাৎ এসেছি। সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে।
আদালত বলেন, আপনাকে এক ঘণ্টা সময় দিলাম। আপনি বিকেল ৪টায় আমাদেরকে জানান, ওষুধ কখন আনা সম্ভব?
এরপর এক ঘণ্টা বিরতির সময় সরকারি আইনজীবীর চেম্বারে বসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে যোগাযোগ করেন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
বিকেল ৪টায় আবার সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ আদালতের এজলাসে এসে ডায়াসের সামনে এসে আদালতকে বলেন, স্যার, অনেক ধন্যবাদ। আমি সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছি। এ ধরনের কীটনাশক চীনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করে। সরকার টু সরকার কেনার সুযোগ নেই। দুই সিটি করপোরেশনকে পর্যাপ্ত লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
এ সময় আদালত বলেন, ওষুধ আনতে কত দিন লাগবে?
জবাবে সচিব হেলালুদ্দীন বলেন, আমি কৃষি সচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। দেশে যেসব নমুনা রয়েছে তা পরীক্ষার জন্য ল্যাবে আনা হয়েছে।
এ সময় আদালত বলেন, দ্রুত সময়ে আনার জন্য রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা দরকার।
আবারো আদালত বলেন, ওষুধ আনতে সমস্যা কোথায়?
জবাবে সচিব বলেন, বেসরকারি খাতে উৎপাদন হয়। ওষুধ আনার জন্য ১৪ দিন সময় লাগবে।
তখন আদালত বলেন, আর কত সময় লাগাবেন? আর কত মানুষ মারা গেলে?
এ সময় সিটি কপোরেশনের আইনজীবীকে আদালত বলেন, আপনারা এতক্ষণ বলেছেন, সরকার আনবে। আর সরকারপক্ষ বলেছে, সিটি কপোরেশন আনবে? এটা নিয়ে টানাটানি চলছে।
দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের আইনজীবীকে আদালত বলেন, আপনি সকালে বলেছেন, বিশেষ বিমানে ওষুধের নমুনা আসতেছে। বিমান কই আসছে?
এ সময় আইনজীবী বলেন, এখনো আসেনি।
জবাবে আদালত বলেন, কোথায় আছে? ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখেন।
আইনজীবী তৌফিক এনাম টিপু বলেন, আমাকে তথ্য দেওয়া হয়। আমরা উপস্থাপন করি। এর বেশি কিছু তো করতে পারি না।
তখন আদালত ওষুধ আনার প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এরপর আদালত আদেশ দেন। আগামী ১৮ আগস্ট এ বিষয়ে আগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে দুই সিটি কপোরেশনকে বলা হয়।
এর আগে বেলা ১১টায় শুনানিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘ওষুধ আনবে সরকার। আমরা শুধু প্রয়োগ করব। গত পরশু দিন আবেদন করেছি। এখনো কোনো কিছুই হয়নি, পড়ে রয়েছে। কোনো কিছুই হচ্ছে না। এই প্রসেস কখনোই শেষ হবে না।’
আদালত বলেন, ‘আমরা ১৬ দিন আগে রুল দিয়েছি। সরকার কি কোনো কাজ করছে না?’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘মিটিং হয়েছে। ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
আইনজীবীরা আদালতকে জানান, বিশেষ বিমানে করে মশা নিধনের নতুন ওষুধের নমুনা আজকের মধ্যে দেশে আসবে। একই সঙ্গে ওই নমুনা ওষুধের কার্যকারিতার ওপর মহাখালীর একটি ল্যাবরেটরিতে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা চালানো হবে বলেও তাঁরা আদালতকে জানিয়েছেন।
তবে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘যখন মশার প্রকোপ শুরু হলো, তখন আপনারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি? দুই সিটি কপোরেশন মশক নিধনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।’
আদালতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তৌফিক ইনাম টিপু। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সায়রা ফাইরোজ।
এর আগে গত ২৫ জুলাই ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দিয়ে এডিস মশা নির্মূল ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে এ সময়ের মধ্যে ওষুধ ব্যবহারে মশা নিধন হয়েছে কি না, সে বিষয়েও প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছিলেন আদালত।
কিন্তু মশা নিধনে কার্যকর ফল না পাওয়ায় গত ৩০ জুলাই এডিস মশা নিধনে কার্যকর ওষুধ কবে দেশে আসবে, তা সরকার এবং ঢাকার উভয় সিটি করপোরেশনকে আজ দুপুর ২টার মধ্যে জানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। যার ধারাবাহিকতায় ওষুধের বিষয়ে তাঁরা হাইকোর্টকে বিষয়টি অবহিত করেন।
এর আগে গত ১৪ জুলাই আদালত তাঁর আদেশে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানাতে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মেয়র, নির্বাহী কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
একই সঙ্গে নাগরিকদের ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়া বন্ধ করতে এবং এডিস মশা নির্মূলে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন আদালত।
পরে ওই বিষয়ে দুই সিটির পক্ষ থেকে গত ২২ জুলাই হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। কিন্তু সে প্রতিবেদনে আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান দুই স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে তলব করলে গত ২৫ জুলাই তাঁরা সশরীরে হাজির হয়ে আদালতে ব্যাখ্যা দেন।