উঁচু-নিচু অসম বিয়ে হলে সমাজচ্যুতির ভয় থাকে!
ভালোবেসে ব্রাহ্মণ বর্ণের মেয়ে সুস্মিতা দেবনাথ অদিতিকে বিয়ে করার পর মিথ্যা মামলায় ১৪ বছর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হরিজন বর্ণের যুবক তুষার দাসকে জামিনের শুনানিকালে আদালত বলেছেন, একটি নির্দিষ্ট মামলার ব্যাপারে (নিম্ন আদালতের) বিচারক সাহেবের এত উৎসাহ কেন? তাঁর কী স্বার্থ? গত ছয় মাসে তাঁর আদালতের পরিসংখ্যান কী তা দেখা দরকার।
আদালত বলেন, তাঁর মতো যদি সারা দেশের বিচারকরা কাজ করতেন তাহলে তো নিম্ন আদালতে মামলার জট থাকতো না।
শুনানিতে আদালত বলেন, এখানে সমস্যা হলো আসামি দলিত সম্প্রদায়ের। আর মেয়ের বাবা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের। এখানে উঁচু-নিচু জাতের একটি বিষয় আছে। আদালত বলেন, আমাদের সমাজে তো এ রকম প্রথা রয়েছে যে এ রকম উঁচু-নিচু অসম বিয়ের ঘটনা ঘটলে সমাজচ্যুতির ভয় থাকে।
আইনজীবী বলেন, আসামি দলিত সম্প্রদায়ের না হলে মামলা ও হয়রানির শিকার হতো না। কিন্তু আমাদের আইনে জাত বা বর্ণ বলে কিছু নেই। আইনের চোখে সবাই সমান। সবাই মানুষ হিসেবে বিবেচিত।
আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ জামিন শুনানিকালে এসব মন্তব্য করেন।
এ সময় আদালত বলেন, যা বাস্তবতা, তা মানতেই হবে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখানে যদি মেয়ের বাবা এই বিয়ে মেনে নেন, তবে যদি তাঁকে সমাজচ্যুত করা হয়, একঘরে করা হয়, তখন কী হবে? সেটাও দেখতে হবে। যদিও আইনে এ রকম উঁচু-নিচু বর্ণে বিয়েতে বাধা নেই। একদিকে আইন, আরেকদিকে বাস্তবতা। সবকিছুই বিবেচনা করতে হবে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
অপহরণের অভিযোগ প্রমাণ হওয়া প্রসঙ্গে হাইকোর্ট বলেন, যেখানে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি রায়েই বলা হয়েছে। সেখানে অপহরণের অভিযোগে কিভাবে সাজা দেয়?
তুষার দাসকে নিম্ন আদালতের দেওয়া ১৪ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, শরীয়তপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আব্দুস ছালাম খান ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগে মায়ের করা মামলায় একদিনেই সাতজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ, আসামির জবানবন্দি, উভয়পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন এবং পরিশেষে রায় দিয়েছেন। রায়ে আসামি তুষার দাস রাজকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অথচ ১১ মাস আগে এই একই বিচারক আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদেশ দিয়েছিলেন। যে মামলায় একবার অব্যাহতি দিলেন, সেই মামলায় আবার কিভাবে সাজা দিলেন? আর একদিনের মধ্যে একটি মামলার বিচার সম্পন্ন করায় হাইকোর্ট বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
স্বামী তুষার দাসের জন্য হাইকোর্টে সুস্মিতা দেবনাথ অদিতি। ছবি : এনটিভি
রাজের জামিনে অদিতির মুখে হাসি
এদিকে গত ৩ মে অদিতির কোলজুড়ে আসে একটি মেয়ে সন্তান। তার নাম রাখা হয়েছে তোর্সা দাস কাব্য। রাজ কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই এই শিশুকে নিয়ে হাইকোর্টের বারান্দায় ঘুরতে থাকেন স্বামীর জামিনের জন্য। অবশেষে আজ জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। আর এই জামিন আদেশের পর তাঁর মুখে ফেরে হাসি। যদিও চোখে ছিল পানি। সুখের খবরে এই পানি বলে জানান অদিতি।
অদিতি তাঁর বাবা-মাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘অনেক হয়েছে। আর আমাদের হয়রানি করো না। আমি তোমাদের সন্তান। আমি ভুল করতেই পারি। আমি ভালোবেসে একজন মানুষকে বিয়ে করেছি। সে কোন সম্প্রদায়ের তা আমার দেখার দরকার নেই। সে একজন মানুষ। তাই তোমরাও আমার স্বামীকে একজন মানুষ হিসেবে মেনে নাও। আর না নিলে আমার আর কিছু বলার নেই।’
পরে আদালত ভালোবেসে ব্রাহ্মণ বর্ণের মেয়ে সুস্মিতা দেবনাথ অদিতিকে বিয়ে করার পর মিথ্যা মামলায় ১৪ বছর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হরিজন বর্ণের যুবক তুষার দাসকে জামিন দেন। এ ছাড়া নিম্ন আদালতের দেওয়া অর্থদণ্ড স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এতে তুষার দাসের মুক্তিতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
আসামি তুষার দাসের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট শিশির মনির। এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট শিশির মুনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘তুষার ও সুস্মিতা ভালোবেসে বিয়ে করেন দুই বছর আগে। তিন মাস আগে তাঁদের কোলজুড়ে এসেছে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। কিন্তু তুষার দাস হরিজন (নিম্ন) বর্ণের হওয়ার কারণে শুরুতেই এ বিয়ে মেনে নিতে পারেননি সুস্মিতার মা-বাবা।’
অ্যাডভোকেট শিশির মুনির আরো জানান, মেয়ে নাবালিকা—এ অভিযোগ তুলে সুস্মিতার বাবা তুষারের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করেন।
মামলার বিবরণী থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর আসামি তুষার দাস ওরফে রাজ ভিকটিম সুস্মিতা ওরফে অদিতিকে অপহরণ করে নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর অপহরণের অভিযোগে সুস্মিতার বাবা বাদী হয়ে ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর শরীয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন।
গত ২৩ জুলাই ওই মামলার রায় হয়। মামলায় অপহরণের দায়ে তুষারকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন শরীয়তপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেলা জজ আবদুস ছালাম খান। সুস্মিতা দেবনাথ স্বেচ্ছায় তুষার দাসকে বিয়ে করার কথা বললেও তাঁর কথা আমলে নেননি নিম্ন আদালত।
অ্যাডভোকেট শিশির মুনির নিম্ন আদালতের রায়ের বরাত দিয়ে জানান, আদালত রায়ে বলেন, সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামি তুষার দাস ওরফে রাজ ভিকটিম সুস্মিতা ওরফে অদিতিকে অপহরণ করে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আসামি শিশু সুস্মিতাকে বিয়ে করবেন—এই আশ্বাস দিয়ে এ অপহরণ করেছেন, যা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ কারণে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
তবে আসামির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তাঁকে ওই দায় থেকে খালাস দেন আদালত।
যেদিন রায় হয়, সেদিনই (২৩ জুলাই) আদালতে আত্মসমর্পণ করেন তুষার। এরপর তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তিনি আপিল করেন।
জামিন শুনানির আগে উচ্চ আদালতে সুস্মিতা দেবনাথ বলেন, ‘আমার একটাই অপরাধ, আমি ব্রাহ্মণ বর্ণের মেয়ে হয়ে হরিজন বর্ণের ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। আইনের মারপ্যাঁচে আমাদের জীবন আজ বিপন্ন। ৮৮ দিন বয়সের শিশুসন্তান নিয়ে আমাকে ফেরারি হয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। মিথ্যা মামলা থেকে আমার স্বামীর মুক্তি চাই।’