কিছু ঝুঁকি সত্ত্বেও রাবেয়া-রোকেয়ার অবস্থা স্থিতিশীল
সম্প্রতি ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) জোড়া মাথার শিশু রাবেয়া ও রোকেয়ার অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এজন্য আজ শনিবার সিএমএইচে কমান্ড্যান্ট কনফারেন্স রুমে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সামরিক চিকিৎসা সার্ভিস মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএমএস) মহাপরিচালক ডা. হাবিব ই মিল্লাত এমপি, ঢাকা সিএমএইচের কমান্ড্যান্ট মেজর জেনারেল মো. ফসিউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তৌফিকুল হাসান সিদ্দিকী, শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন, অ্যাকশন ফর ডিফেন্সলেস পিপলের ডা. গ্রেগ পাটাকি (প্লাস্টিক সার্জন), ডা. এনড্রুস চকে (নিউরো সার্জন), ডা. মার্সেল (পেডিয়াট্রিকস ইনটেন্সিভিস্ট) এবং রাবেয়া-রোকেয়ার বাবা ও মা উপস্থিত ছিলেন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে রাবেয়া ও রোকেয়ার সফল অস্ত্রোপচার সম্পর্কে সাংবাদিকদের বিস্তারিত তথ্য ও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়।
পাবনার চাটমোহর উপজেলার রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা বেগম দম্পতির ঘরে ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই জন্ম নেয় বিরল দুই কন্যাশিশু। যাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় Craniopagus twins। কনজয়েন্ট টুইন অথবা মাথা জোড়া লাগানো জমজ বাচ্চা চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২৫ লাখ জীবিত জমজ বাচ্চার মধ্যে মাত্র একটি মাথা জোড়া লাগানো বাচ্চা জন্ম নেয়। প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ মাথা জোড়া লাগানো শিশু মৃত অবস্থায় জন্ম নেয়। আরো এক তৃতীয়াংশ শিশু ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়। তবে শতকরা ২৫ ভাগ শিশু বেঁচে থাকে জমজ মাথা নিয়ে, যাদের শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে আলাদা করার সুযোগ থাকে। এটি একটি বিরল ধরনের অপারেশন। সারা বিশ্বে খুব অল্প পরিমাণে হয়েছে। সাফল্যের হারও খুব বেশি নয়।
এই জোড়া মাথার শিশু জন্ম দেওয়ার জন্য বাবা ও মাকে পেতে হয়েছিল সমাজের নানা তিরস্কার। এ ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লেখেন। পরে বিস্তারিত জানার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের নিয়ে আসা হয়। এখানে শিশুটির চিকিৎসার সব কাজে ডা. হাবিব ই মিল্লাত ও ডা. সামন্তলাল সেন সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন।
ঢাকা সিএমএইচে জোড়া মাথার শিশুর সফল অপারেশনের পর সংবাদ সম্মেলন। ছবি : আইএসপিআর
হাংগেরির অ্যাকশন ফর ডিফেন্সলেস পিপলের ডা. গ্রেগ পাটাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে হাংগেরি জনগণের পক্ষ থেকে এদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব বলে মত দেন।
শিশু দুটির চিকিৎসা কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং গত ৪ জানুয়ারি থেকে হাংগেরিতে ৪৮টি ছোট বড় সার্জারি সম্পন্ন করা হয়। এর পর ২২ জুলাই রাবেয়া ও রোকেয়ার অস্ত্রোপচারের সবচেয়ে জটিল অংশ ‘জমজ মস্তিষ্ক’ আলাদা করার কাজটি। সেটি সম্পন্ন করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হাংগেরি থেকে তাদের ঢাকা সিএমএইচে নিয়ে আসা হয়। সেনাপ্রধান সব সহযোগিতার জন্য ডিজিএমএসকে বিস্তারিত নির্দেশনা দেন।
গত ১ আগস্ট রাত ১টার দিকে পৃথকীকরণের জটিল অপারেশনটি শুরু হয়। ৩৩ ঘণ্টাব্যাপী অপারেশনের পর ২ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় শেষ হয়।
এই অস্ত্রোপচারে হাংগেরি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সিএমএইচের নিউরো অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের তত্ত্বাবধায়নে নিউরো ও প্লাস্টিক সার্জনরাসহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট, হার্ট ফাউন্ডেশন, নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতালের শতাধিক সার্জন ও অ্যানেসথেসিওলজিস্ট এই জটিল অপারেশনে বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত ছিলেন।
বর্তমানে তারা ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের পোস্ট অ্যানেসথেটিক কেয়ার ইউনিটে অবস্থান করছে। শিশু দুটি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এবং শিশু হাসপাতালের নিউরো ইনটেনসিভিস্টদের তত্ত্বাবধায়নে রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, আজ শনিবার রাবেয়া-রোকেয়াকে পৃথকীকরণের অষ্টম দিন অতিবাহিত হচ্ছে। অপারেশনের পর এখানে তারা কিছু ঝুঁকি সত্ত্বেও স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার এ ধরনের অস্ত্রোপচারে পরবর্তী ঝুঁকি এবং জটিলতা অত্যন্ত বেশি।
উল্লেখ করা প্রয়োজন রাবেয়া ও রোকেয়ার আরো একটি অপারেশন (ক্রেনিওপ্লাস্টি) দুই থেকে তিন মাস পর করা প্রয়োজন। আমরা মনে করি, এ ধরনের চিকিৎসা সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও হাংগেরির জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো জোরদার হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
যে অন্ধকার অমানিশার মধ্যে রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা বেগম দম্পতি পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও হাংগেরির অ্যাকশন ফর ডিফেন্সলেস পিপলের সহায়তায় তারা অপার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন।
সংবাদ সংম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকার প্লাস্টিক নিউরো সার্জন, নিউরো অ্যানেসথেসিয়া এবং পেডিয়াট্রিক চিকিৎসক ও ইনটেনসিভিস্টরা।
আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট, হার্ট ফাউন্ডেশন, নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট, শিশু হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং দেশি-বিদেশি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা।