এক বছরের বাচ্চার কথা বলায় বেঁচে যান শাহানারা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সন্ত্রাসবাদবিরোধী সমাবেশের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। দুপুর থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে যোগ দেন নেতাকর্মীরা। সবার মতো সেই সমাবেশে যোগ দেন তৎকালীন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা শাহানারা ইয়াসমিন।
সেই দিনের সেই ভয়াল ঘটনা নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন শাহানারা ইয়াসমিন। বর্তমানে তিনি সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঘটনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কথার মাঝে প্রায়ই থেমে যান তিনি। নিশ্বাস নিয়ে আবার বলা শুরু করেন।
শাহানারা ইয়াসমিন বলেন, ‘নেত্রী (আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) বক্তব্য দেওয়া শেষ করে মাত্র এক পা সামনে আগালেন, এমন সময় হঠাৎ করে বিকট আওয়াজ শুনলাম। এরপর আরেকটি আওয়াজ। আমার পাশে আইভি আপা সোজা পড়ে গেলেন। আমি দৌঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আমার পা নড়ছিল না। এরপর আবার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম আমার শরীর রক্তে ভেসে গেছে। এরপর আমি সেন্সলেস (অজ্ঞান) হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে দেখলাম, লাশ আর লাশ। আমি বলছিলাম, বাঁচাও বাঁচাও। কয়েকজন আমাকে ধরাধরি করে সামনে নিয়ে চলল। এ সময় পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ শুরু করে। তখন আমাকে যারা নিয়ে যাচ্ছিল, তারা বললেন, ‘আপনাকে বাঁচাতে পারলাম না, রেখে গেলাম।’ আমি কান্না করে বললাম, ‘বাসায় আমার একটা এক বছরের বাচ্চা রেখে আসছি।’ তখন তারা আমাকে আবার নিয়ে গেল। এরপর ঢাকা মেডিকেল। তারপর সিকদার মেডিকেলে। এখন পর্যন্ত ছয়টা অপারেশন হয়েছে। ভারতে গিয়েও চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু স্প্লিন্টারের আঘাতে শরীরে সেনসিটিভ জায়গাগুলো খুব যন্ত্রণা করে। এ যন্ত্রণার কষ্ট শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুঝেন। এখন পর্যন্ত চিকিৎসার সব খরচ প্রধানমন্ত্রী বহন করেছেন। তিনি আমাদের শেষ আশ্রয়।’
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন সে সময়ের বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা। অস্থায়ী ট্রাকমঞ্চে বক্তব্য শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে একের পর এক গ্রেনেড ছোড়া হয়। উপর্যুপরি ১৩টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণে মুহূর্তেই সমাবেশস্থল পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন নেতা সেদিন অল্পের জন্য এই ভয়াবহ হামলা থেকে বেঁচে গেলেও মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেগম আইভি রহমানসহ ২২ জন নিহত হন। এ ছাড়া এই হামলায় আরো ৪০০ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
গ্রেনেড হামলায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা). মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন ও ইসাহাক মিয়া।
মারাত্মক আহতরা হলেন শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা পারভীন, অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, নাসিমা ফেরদৌস, শাহানারা ইয়াসমিন, শাহিদা তারেক দীপ্তি, রাশেদা আখতার রুমা, হামিদা খানম মনি, ইঞ্জিনিয়ার সেলিম, রুমা ইসলাম, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, মামুন মল্লিক, জোবায়দুল হক রাসেল প্রমুখ।